খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়লায় প্রচুর পরিমাণে সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, পারদ ও আর্সেনিক থাকে। এগুলো মানুষ ও প্রাণীর শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ফলে এসব রাসায়নিক পদার্থে আক্রান্ত হবে মাছসহ জলজ প্রাণী। সেগুলো থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষও। তাছাড়া, এসব পদার্থ মাটিতে মিশে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করবে। এতে অঙ্কুরোদগম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ক্ষতি অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে তেলবাহী জাহাজ ডুবেছে সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে। সেই তেল ছিল ভাসমান। তবে কয়লার রাসায়নিক পদার্থ পানি-মাটি সবখানে মিশে যাবে এবং ছড়িয়ে পড়বে।’
সুন্দরবনে কয়লার বিষাক্ত উপাদানের ক্ষতির প্রভাব সম্পর্কে এই অধ্যাপক বলেন, ‘হারবাড়িয়া এলাকা ইরাবতী ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্র। কুমিরের প্রজননেরও সময় এটা। ফলে কয়লার বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে ডলফিন ও কুমিরের জীবনচক্র ব্যাহত হতে পারে। অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননও হুমকিতে পড়বে। একইসঙ্গে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী ভেতর থেকে আক্রান্ত হবে। এভাবে এই বিষ যুক্ত হয়ে পড়বে খাদ্যচক্রে।’
কেবল প্রাণীই নয়, উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে কয়লার রাসায়নিক পদার্থ। ড. আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, ‘কয়লার বিষ মাটিতে মিশে গুণাগুণ নষ্ট করবে এবং অঙ্কুরোদগম ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বংশ বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রুণ নষ্ট হবে। অনেক ক্ষেত্রে জলজ ও বনজ প্রাণী মরে পচে থাকবে। সাদা চোখে হয়তো এই প্রভাব বোঝা যাবে না, কিন্তু এর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী।’
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘কয়লাসহ কার্গো ডুবে যাওয়ায় সুন্দরবনের জলজ প্রাণীর অস্তিত্বসহ জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হবে। কারণ এসব কয়লায় সালফারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, যা পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ডুবন্ত নৌযানে থাকা তেল, মবিলও পানির সঙ্গে মিশে যায়। এসব পদার্থও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লাবাহী কার্গোর চলাচল বাড়বে। এর সঙ্গে এ ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়বে।’
সুন্দরবন রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান দিলিপ কুমার দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ঠেকাতে হবে। কয়লাসহ কার্গোডুবি প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট। এ ধরনের বিপদ সুন্দরবনের পিছু ছাড়ছে না।’ তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা শর্ত মানছেন না। শর্তগুলো পালন হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও মনিটরিং নেই।’
এদিকে, হাড়বাড়িয়ায় কয়লাসহ কার্গোডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) বিভাগীয় কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রাথমিক একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে সেই প্রতিবেদনে সুন্দরবন ও এর আশপাশের পরিবেশ ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কার্গো উদ্ধার হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শাহিন কবির।
এদিকে, রবিবার ভোরে কয়লাবাহী কার্গো এমভি বিলাস ডুবে গেলেও বুধবার রাত পর্যন্তও কার্গোটি উদ্ধারের কাজ শুরু হয়নি। কয়লা আমদানি প্রতিষ্ঠান সাহারা এন্টারপ্রাইজের অপারেশন ম্যানেজার লালন হাওলাদার জানান, বৃহস্পতিবার এই কাজ শুরু হতে পারে। মোংলা বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার ওলিউল্লাহ জানান, মালিকপক্ষ প্রথমে কার্গো থেকে কয়লা তুলবে, পরে কার্গোটি তোলা হবে।
উল্লেখ্য, গত ১৫ এপ্রিল ভোরে ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে মাদার ভ্যাসেল থেকে ছেড়ে আসার পথে হারবাড়িয়া ৫ ও ৬ নম্বর বয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ডুবে যায় এমভি বিলাস। এ ঘটনায় মোংলা থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করা হয়েছে। কার্গোটি উদ্ধারের জন্য মালিকপক্ষকে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বন বিভাগের তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালকের অদক্ষতার কারণেই কার্গোটি ডুবে গেছে।
সুন্দরবনের আশপাশের নদীগুলোতে কয়লা বা তেলবাহী কার্গো জাহাজডুবির ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ডুবে যায় তেলবাহী ট্যাংকার এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন। ২০১৫ সালের ৩ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবে যায় সারবোঝাই কার্গো জাহাজ এমবি জাবালে নূর। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের শরণখোলার রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবতে ডুবতে অন্য কার্গোর সহায়তায় মোংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় আরেকটি কয়লা বোঝাই কার্গো। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবরেই সুন্দরবনের পশুর নদীতে ৫১০ মেট্রিন টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় এমভি জিয়া রাজ। পরের বছরের ১৯ মার্চ বিকালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর ‘হরিণটানা’ বন টহল ফাঁড়ির কাছে ১,২৩৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে এমভি সি হর্স-১ ডুবে যায়। ২০১৭ সালের ৪ জুন দিবাগত রাতে হারবাড়িয়া চ্যানেলে ৮২৫ টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল স্লাগসহ এমভি সেবা নামে আরেকটি কার্গো জাহাজ তলা ফেটে ডুবে যায়।
আরও পড়ুন-
বিপদ পিছু ছাড়ছে না সুন্দরবনের!
পশুর নদীতে কার্গোডুবি: পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
চালকের অদক্ষতায় কার্গোডুবি, চার দিনেও শুরু হয়নি উদ্ধার কাজ