খুলনায় ২৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান, শঙ্কায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা

ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনখুলনার ২৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব ভবনে ঝুঁকি নিয়েই চলছে পাঠদান। দুর্ঘটনা শঙ্কা থাকলেও নিরুপায় হয়ে এসব ভবনে ক্লাস করতে বাধ্য হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এতে করে চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন অভিভাবকরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, খুলনা মহানগরী ও জেলার ৯টি উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে এক হাজার ২৯৯টি। যার মধ্যে ২৩০টি ঝুঁকিতে রয়েছে। সদর থানায় ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৯টি। এছাড়া কয়রা উপজেলায় ১৪২টির মধ্যে ২৯টি, ডুমুরিয়ায় ২১৪টির মধ্যে ৫৭টি, তেরখাদায় ১০২টির মধ্যে ২৫টি, দাকোপে ১১৯টির মধ্যে ১২টি, দিঘলিয়ায় ১৫০টির মধ্যে চারটি, পাইকগাছায় ১৬৭টির মধ্যে ২৩টি, ফুলতলায় ৫৫টির মধ্যে ১৮টি, বটিয়াঘাটায় ১৫৫টির মধ্যে ২০টি, রূপসায় ৬৮টির মধ্যে ১৩টি স্কুল ভবনকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে জেলা শিক্ষা অফিস।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে গত ৯ এপ্রিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে পাঠিয়েছে খুলনা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। এর আগে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করেন।

ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনসোনাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাছিমা বেগম বলেন, ‘ এই স্কুলের ভবনটি নষ্ট হওযায় খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে অন্য স্কুলে নিয়ে ক্লাস করানোর ফলে উদ্বেগ কিছুটা কমেছে। তবে হতাশা কাটেনি। কবে যে মেয়েকে মূল স্কুলের নতুন ভবনে ক্লাস করতে পাঠাতে পারবো জানি না।’

শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, খুলনা মহানগরীতে ১২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০টি অতি জরাজীর্ণ ও ঝুকিপূর্ণ। যার কয়েকটি বন্ধ রয়েছে। বন্ধ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাঠদান পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠানে করাতে বাধ্য হয়েছে জেলা শিক্ষা অফিস। সোনাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অতিঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের সোনাডাঙ্গা আবু বক্কর খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে ক্লাস করানো হয়। কিন্তু এই স্কুলটিও অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে।

সোনাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘২০১৫ সালে স্কুল ভবনটি নষ্ট হওয়ার পর থেকে আমরা অন্যত্র ক্লাস করাচ্ছি। স্কুল ভবনের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। আবু বকর খান স্কুলে কক্ষ না থাকায় এক কক্ষে দু’টি ক্লাস নিতে হয়। এখানে আমাদের স্কুলের ৯ জন শিক্ষক ও ১১৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চরম সঙ্কটে কাটছে।’

ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনরূপসা উপজেলা শিক্ষা অফিসার মুহা. আবুল কাশেম তার উপজেলা থেকে ৯টি ঝুঁকিপূর্ণ স্কুলের নাম পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এখন বিদ্যালয় ছুটি থাকায় ক্লাস হয় না। তবে ক্লাস ওই সব ঝুকিঁপূর্ণ ভবনেই হয়ে থাকে।’ তবে এসব ভবন তেমন ঝুঁকিপূর্ণ না বলেও জানান তিনি।

ফুলতলা উপজেলা শিক্ষা অফিসার চায়না রাণী দত্ত বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই ক্লাস নেওয়া হয়। ক্লাস নেওয়ার অন্য জায়গা না থাকায় ওই ভবনেই ক্লাস নিতে হয়।’

তেরখাদা উপজেলা শিক্ষা অফিসার শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সবগুলো বিদ্যালয় তো আর একই রকম না। কোনোটায় ক্লাস হয়, আবার কোনোটাতে হয় না। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কোনও কক্ষ ভালো থাকলে, সেখানে ক্লাস নেওয়া হয়।’ তবে কোনও ভবন একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অন্য কোথাও ক্লাস নেওয়া হয় কিনা, তা তিনি বলতে পারেননি।

খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এএসএম সিরাজুদ্দোহা বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। এখন বিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটা অধিদফতরের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল দেখভাল করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্কুলের মধ্যে কিছু স্কুলকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এসব স্কুলের পাঠদান অন্য স্কুলের সঙ্গে একত্রে নেওয়া হয়।’

ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনখুলনা গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলটির জরাজীর্ণ ও ঝুকিপুর্ণ ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকায় বিদ্যালয়ের অবকাঠামো স্বল্পতায় শিক্ষা কার্যক্রসেমে বিঘ্ন ঘটছে। বিদ্যালয়টির পুরাতন ভবনে জোড়াতালি দিয়ে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। ক্লাস চলাকালে ছাদের অংশ বিশেষ ভেঙে শিক্ষার্থী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেয়নি এখনও কোনও উদ্যোগ। প্রায় এক হাজার ৫০ জন শিক্ষার্থী ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্কুলটিতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুল চলাকালে স্কুলের নিচতলার আষ্টম শ্রেণির গোলাপ শাখার নির্ধারিত ১০৬ নম্বর কক্ষে ছাদের দুটি অংশ ভেঙে পড়ে। বৈরী আবহওয়ার কারণে ওইদিন শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না থাকায়, বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে না।
সরকারি এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. খালেদা খানম বলেন, ‘অবকাঠামোর অবস্থা খুবই নাজুক। ১৯৬৭ সালে নির্মিত ভবনগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে পারত্যক্ত ঘোষণা করে নতুন ভবন নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। বিষয়টি অবহিত করে সংশ্লিষ্ট দফতরে একাধিকবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনও প্রতিকার দেখা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষার আধুনিকায়ন চলছে। অথচ ভবনের ক্ষেত্রে পুরাতন সেই অবকাঠামো রয়ে গেছে।’

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পুরাতন ভবন সংস্কার করা হচ্ছে। অডিটরিয়াম ভবনসহ ঝুঁকিপুর্ণ ভবন কনডেম ঘোষণার জন্য জেলা প্রশাসক কমিটি গঠন করেছে।’