ফুল ও সবজি চাষে সফল ‘ড্রিপ ইরিগেশন’

Jessore-Dip-Irrigation-pic-2যশোরের ঝিকরগাছায় ‘ড্রিপ ইরিগেশন’ পদ্ধতিতে ফুল ও সবজি চাষে সফলতা পাওয়ায় দেশের ২৬টি উপজেলায় নতুন করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। চাষিরা জানান, ডাগওয়েলের (পাতকুয়া) মাধ্যমে খুব গভীর থেকে পানি উত্তোলন ও উপরে বৃষ্টির পানির ধারা কুয়াতে সংরক্ষণ করে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পানিতে আর্সেনিক থাকে না। তাছাড়া সৌরশক্তি ব্যবহার করায় বিদ্যুৎ বা ডিজেলের ব্যবহারও নেই। পলি হাউজে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও পানি সরবরাহের কারণে অপচয়ও হয় না। পোকামাকড়ের আক্রমণ না থাকায় কীটনাশকের ব্যবহারও তেমন একটা করা লাগে না। সবমিলিয়ে এখানে ফুল–সবজি উৎপাদন খরচ কম এবং ফলন অনেক বেশি হয়।

যশোর বিএডিসির (সেচ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল রশিদ বলেন, ‘এই উদ্যোগ বিদ্যুৎ-জ্বালানি মুক্ত ও পানি সাশ্রয়ী। ঝিকরগাছা অঞ্চলের কৃষকেরা এর সুফল পেয়েছেন, তারা সানন্দে এটি গ্রহণ করেছেন। এই কর্মসূচির সফলতায় দেশের ২৬টি উপজেলায় যেখানে বারোমাসি ফুল ও সবজি চাষ করা হয়, সেখানে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করা যায়।’

Jessore-Dip-Irrigation-pic-1বিএডিসি (সেচ) যশোর অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৪০ ফুট গভীর ডাগওয়েল (পাতকুয়া) ও ১০১০ বর্গমিটার দৈর্ঘ্যের সাদা পলিথিন দিয়ে লোহার কাঠামোর ওপর তৈরি করা হয়েছে পলি হাউজ। হাউজের জন্য পলিথিন আনা হয়েছে ভারত থেকে, যা ইসরায়েলে তৈরি। এই হাউজ ১২০ কিলোমিটার বেগের ঝড়ো হাওয়া প্রতিরোধ করতে সক্ষম। ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচতি যশোরের গদখালিতে ড্রিপ ইরিগেশন কর্মসূচির আওতায় ১৫টি ডাগওয়েল ও ছয়টি শেড নির্মাণ করা হয়েছে। ঝিকরগাছা উপজেলায় ফুল ও সবজি উৎপাদন সম্প্রসারণে তিন বছর মেয়াদি ড্রিপ ইরিগেশন কর্মসূচি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুরু হয়। এতে বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ৭ কোটি টাকা। বিএডিসি যশোরের সেচ বিভাগ এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় ফুল ও সবজি উৎপাদন সম্প্রসারণে ড্রিপ ইরিগেশন কর্মসূচি।’

ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের শাহজাহান কবীর চাষাবাদের জন্য ডাগওয়েল ও শেড (পলি হাউজ) দুটোই গ্রহণ করেছেন, চাষ করছেন জারবেরা। তিনি বলেন, ‘এই প্রযুক্তি আসার পরই গ্রহণ করি। ডাগওয়েল বা পাতকুয়া থেকে সৌরচালিত পাম্পের মাধ্যমে তোলা হয় পানি। আর বর্ষামৌসুমে বৃষ্টির পানি উপরে থাকা চোঙার মাধ্যমে কুয়ায় নেমে আসে। সেখান থেকে সরবরাহ লাইনের (পাইপ) মাধ্যমে পানি চলে যায় সোজা ফুল ও সবজিক্ষেতে। ফুল ও সবজিগাছের গোড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে পানি।’

Jessore-Dip-Irrigation-pic-4শাহজাহান কবীর বলেন, ‘আমার এই সেচ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ৩০ জন কৃষক সম্পৃক্ত। খুব গভীর থেকে পানি উত্তোলন ও বৃষ্টির পানি সংগ্রহ- দুটোই আর্সেনিকমুক্ত। এই সেচের মাধ্যমে আমরা সুফল পাচ্ছি।’

বিএডিসির এই কর্মসূচির প্রথম গ্রাহক ফুল ও সবজিচাষি ইসমাইল হোসেন। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি ফুল ও সবজি চাষ করছেন। ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমার ২৪ বিঘার মধ্যে ১২ বিঘা ড্রিপ ইরিগেশনের আওতায়। প্রথমে অল্প পরিসরে কাজ শুরু করেছিলাম। বিএডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুব আলম সরেজমিনে এসে চাষাবাদের সফলতা দেখে যান। পরে এই কর্মসূচি বিস্তৃত হয়।’

ইসমাইল হোসেন জানান, ‘পলি হাউজের উপরের দিকে রয়েছে ফগার মেশিন। সেখান থেকে কুয়াশার মতো করে পানি বের হয়। পলি হাউজের পলিথিন ওঠানামা করিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে। সেই কারণে কীটনাশকের ব্যবহার করা লাগে না।’

ফুলচাষি মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘বোঁটা লম্বা চায়না রোজের প্রথম জাত আমি ঝিকরগাছায় আনি। এই জাতের গোলাপ বেশ সেনসিটিভ, পরিমিত সেচ ও নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা না হলে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। গত বছর অতিরিক্ত বৃষ্টিতে আমার প্রায় ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। আমি ড্রিপ ইরিগেশনের এই পদ্ধতির জন্য আবেদন করেছি। না পেলে নিজ উদ্যোগেই সেটি করতে হবে।’

Jessore-Dip-Irrigation-pic-5আসাদুল ইসলাম নামের এক চাষী জানান, এই সেচের আওতায় (ডাগওয়েল ও পলি হাউজ) আসতে তাদের ২২ হাজার টাকা জামানত দিতে হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে করতে হলে ৩০ থেকে ৪০ লাখের মতো খরচ হবে। যেহেতু সিকিউরিটি মানি খুব অল্প, সেই কারণে কৃষকদের এই পদ্ধতি গ্রহণ বেশ লাভজনক।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম জানান, ঢালাও সেচে পানির অপচয় হয়। এই কর্মসূচিতে চাষি উপকৃত হচ্ছেন। ফুল ও সবজি চাষে খরচ এবং ঝুঁকিও কমছে। এটি কৃষকদের মাঝে সাড়া ফেলেছে। যশোরের ৭৫টি গ্রামে ফুলচাষ হয়। পর্যায়ক্রমে সবাইকে এই কর্মসূচির আওতায় আনতে সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।