নৌকায় ভোট দেওয়ায় শার্শায় শতাধিক বাড়িতে হামলা

ছোট বোন বিথীকে নিয়ে ঘরে টেলিভিশন, ফ্রিজ, সেলাই মেশিন, আলমারি ও ড্রেসিং টেবিলসহ ভাঙা আসবাবের টুকরো ও কাঁচ পরিষ্কার করছিলেন সাথী। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। তাদের বাবা ডা. লুৎফর রহমান বাড়িতে নেই। রবিবার (২৮ নভেম্বর) রাতে হামলার ভয়ে আত্মগোপন করেছেন।

উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী সাথী জানান, গত রাতে মা কাজল রেখা ও ছোট বোন বিথীকে নিয়ে বাড়িতে ছিলেন। এশার আজানের পর ৪০ জনের একটি দল তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। ঘরের বাইরে ছিল লুৎফর রহমানের মোটরসাইকেল। প্রথমে সেটা ভেঙে ফেলে তারা। এরপর ঘরে ঢুকে আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রিজ সব ভেঙে টুকরো টুকরো করে। বাধা দিলে কাজল রেখাকেও মারধর করে। 

কাজল রেখা জানান, তার স্বামী মোটরসাইকেলে ওষুধ নিয়ে বাজারে বাজারে বিক্রি করেন। বার বাসায় কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন তিনি। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তারা নৌকার সমর্থক ছিলেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর লোকজন এই হামলা চালিয়েছে।

আসবাবপত্রসহ গাড়িতেও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা

তাদের বাড়ির পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করছিলেন ফাতেমা বেগম (৭০)। তার স্বামী বাবর আলী। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান। গেট পার হয়েই একটি কাপড়ে ঢাকা মাইক্রোবাস চোখে পড়ে। গাড়িটির সব গ্লাস ভাঙা। কাঁচের টুকরো পড়ে আছে মাটিতে। পাশে একতলা নতুন ভবন। এই বাড়ির প্রত্যেকটি জানালার গ্লাস ভাঙা। বাইরে টয়লেটের দরজায় অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন।

ফাতেমা বেগম জানান, তার তিন ছেলে দেশে থাকেন। কৃষিকাজ করেন। বিদেশে থাকেন এক ছেলে ও এক মেয়ে। মাইক্রোবাসটি মেয়ে কিনে দিয়েছেন ভাড়ায় চালানোর জন্যে। গত তিন মাস এটা বাড়িতে রয়েছে। তারা নৌকা প্রতীকের সমর্থক ছিলেন। গতরাতে ফলাফল ঘোষণার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আব্দুল খালেকের (আনারস মার্কা) লোকজন বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। ভয়ে তার ছেলেরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

তৃতীয় ধাপে যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে নির্বাচন ছিল রবিবার। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইলিয়াছ কবির বকুল পরাজিত হন। বিজয়ী হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল খালেক (আনারস)। ভোটগ্রহণ শেষে ফলাফল ঘোষণার পর রাতে ইউনিয়নের দুই নম্বর কলোনি (৫০ ঘর) এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে।

ফলাফল ঘোষণার পরই হামলা চালানো হয়

একই অভিযোগ করেন নৌকা প্রতীকের সংরক্ষিত নারী আসনের (১,২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড) সদস্য প্রার্থী ঝরণা বেগম। তিনি বলেন, ভোট গণনা শেষ হওয়া মাত্র আনারসের লোকজন তার বাড়িতে হানা দেয়। দরজা, গেট ও গ্রিলে আঘাত করে এবং অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে। ‘বাড়ি থেকে বের হলে খবর আছে’ বলে হুমকিও দেয়। ভয়ে তিনি ও তার স্বামী ইজিবাইকচালক সিরাজুল ইসলাম বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না।

তাদের বাড়ির পরের পাড়ায় থাকেন (ঘোষপাড়া) মাসুদুর রহমান। তার স্ত্রী আসমা বেগম জানান, গতরাতে ৭-৮ জন এসে কুপিয়ে বাড়ির বেড়া, ঘরের টালি, টিন ও বাথরুমের দরজা ভেঙে ফেলেছে। মাসুদকে খুঁজছিলেন তারা।

ইলিয়াছ কবির বকুলের দাবি, আনারসের প্রার্থী জেতার লাভের পর পরই তারা নৌকার প্রতীক নামিয়ে তাদের (আনারসের অফিসে) টাঙিয়ে দেয়। এরপর রাতভর নৌকা সমর্থিত শতাধিক কর্মীর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর চালায় এবং মারধর করে। বাড়ির পাশাপাশি তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসও ভাঙচুর করে।

ঘরে ঢুকে আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রিজ সব ভেঙে টুকরো টুকরো করে

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল খালেক বলেন, ‘আপনারা রিউমার (গুজব) শুনেছেন। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার কোনও কর্মী কাউকে আঘাত করতে পারে না। তারা মিথ্যাকে সত্য করার গোয়েবলসীয় পদ্ধতি ব্যবহার করছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে ৭-৮ জন ইউপি সদস্য প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাদের একজন পাস করেছে, অন্যরা দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়েছেন। এতে আমার কোনও ইন্ধন নেই। আমি স্পষ্ট বলেছি, এখানে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নাভারণ সার্কেল) জুয়েল ইমরান জানান, ‘আমাদের কাছে বাড়িঘরে হামলার সঠিক তথ্য নেই। আমাদের টিম ঘটনাস্থলে রয়েছে। যে যে স্থান থেকে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই টিম পাঠানো হচ্ছে। আমরা অভিযোগ নিচ্ছি, মামলা হবে। মামলার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’