এক মেশিনে বদলে গেছে কারিগরদের জীবন

হাতে আঁকা ছবির ওপর বাটালি-হাতুড়ি দিয়ে কাঠের আসবাবপত্রে নকশা তৈরি শত শত বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু বর্তমানে আসবাবপত্র অলঙ্করণে কম্পিউটারচালিত যন্ত্রের ব্যবহার কারিগরদের কাজের ধরন পাল্টে দিয়েছে। সেই বদলে গেছে তাদের জীবন।

যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল, নাভারন, শার্শা ও বাগআঁচড়া বাজারে কাঠের আসবাবপত্রের দোকানগুলোতে এই ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শার্শায় প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ নকশা তৈরির কাজে যুক্ত। 

কারিগররা বলছেন, বংশ পরম্পরায় এই পেশায় এসেছেন তারা। আগে তেমন আয় ছিল না। কিন্তু এখন যন্ত্রে নকশা তুলে যে আয় হয় তাতে খেয়ে পরে ভালো আছেন। জায়গা-জমি কিনে, ঘরবাড়ি করেছেন।

তারা জানান, নকশা তৈরির কাজে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সেটাকে কেউ বলে ‘বগা মেশিন’, কারও ভাষায় ‘জিগির মেশিন’। তবে তার পোশামি নাম ‘রোটার’। কম্পিউটারচালিত এই রোটার মেশিন করিগরদের সময় বাঁচিয়েছে, সেই সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়েছে আয়।

বেনাপোলের বাহাদুরপুর সড়কে ঘুরে জানা যায়, আগে অনেকেই আসবাবপত্র তৈরি করে বিক্রি করলেও এখন তাদের কেউ কেউ তা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা এখন শুধু ক্রেতাদের কিংবা ফার্নিচার দোকানিদের দেওয়া কাঠের ওপর নকশা করে দেন।

এক সময় অভাবে দিন কাটতো সামটা গ্রামের রাজমিস্ত্রি নজরুল ইসলামের। তার ছেলে মনির হোসেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বই-খাতা গুছিয়ে কাঠমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজে যোগ দেন। বাবা রাজমিস্ত্রি হলেও ছেলের আসবাবপত্রের মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে সংগ্রামী জীবন শুরু হয়। এখন নিজে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘রাকিব নকশা ঘর’।

রোটার মেশিন করিগরদের সময় বাঁচিয়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে আয়

মনির হোসেন জানান, যশোর ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ তার কাছে আসে টেবিল, চেয়ার, খাট, পালঙ্ক, আলমারি, দরজা-জানালার কাঠে নকশা খোদায় করতে। তার হাত ধরে এলাকার অন্তত ১০০ জন এই পেশায় এসেছে।

তিনি বলেন, ‌‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। এখন তার সুফল পাচ্ছি। এই কাজ করে জমি কিনেছি, পাকা বাড়ি করেছি। সন্তানের লেখাপড়া করাচ্ছি। নিজ হাতে কাজ করি। তাই ভালো কিছুর আশায় এখনও দূর-দূরান্তের মানুষ আসে।’

মনির জানান, যন্ত্র ব্যবহারে সময় ও পরিশ্রম কম, সুবিধাও বেশি। তারপরও কাঠ জোড়া দেওয়াসহ হাতে যে কাজটুকু করার কথা, তা তিনি নিজেই করেন। তার অধীনে কাজ করছেন পাঁচ জন। আরিফ, রিপন, শুভ, ইশান ও মাছুম ছোটো আকারের যন্ত্রে কাজ করেন।

নাভারন বাজারের আজিজুল ইসলাম বলেন, যন্ত্রের সাহায্যে আসবাবপত্রে কারুকাজ করার জন্য এলাকায় পরিচিতদের একজন মনির। তিনি আসবাবপত্রে ফুল, প্রকৃতি ও পশু-পাখির নকশা তৈরি করেন। আপনজনদের প্রতিকৃতিও খোদাই করে দেন।

আজিজুল জানান, এখন আর হাতে নকশা করা হয় না। যে কাজ আগে হাতে করলে লাগতো ৩০ ঘণ্টা, এখন লাগে প্রায় অর্ধেক সময়। তবে যন্ত্রের ব্যবহারে ঝুঁকি আছে। যন্ত্র চালাতে ভুল হলে কাঠ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

টেংরা গ্রামের কারিগর মুছা করিম বলেন, তিন জন লোক কাজ করলে আগে একটা বক্স খাট তৈরি করতে সময় লাগতো আট দিন। এখন লাগে চার দিন। এতে তিন জনের চার দিনের মুজুরি বাঁচে। তবে নকশা কাটাতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।

গোড়পাড়া বাজারের আসবাবপত্র মিস্ত্রি ও দোকান মালিক আব্দুল মালেক বলেন, আমি ফার্নিচার তৈরি করে বিক্রি করি। নিজ হাতে কাজ করি। রোটার আমার নেই, তাই অন্যের কাছ থেকে নকশা কেটে আনি। তবে ছোটোখাটো নকশা বাটালি দিয়ে নিজেই তৈরি করি।

বাগআঁচড়া বাজারের কাঠমিস্ত্রি আবু বক্কর ছিদ্দিক প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে ‘কম্পিউটার রোটার’ যন্ত্রের মাধ্যমে নকশা কাটার কাজ করছেন। যশোর ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসবাবপত্র তৈরির কাজ পান বলেও জানান তিনি।

আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, কাঠের আসবাবপত্রে হাতের কাজ উঠেই যাচ্ছে। নকশা বলতেই এখন যন্ত্রের নকশা। রোটার যন্ত্র দিয়ে কম্পিউটারের সাহায্যে নকশা কাঠে তৈরি করে দিচ্ছি। প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার টাকার নকশা এই যন্ত্রের সাহায্যে কাটা সম্ভব।