পর পর দুই বছর করোনার সংক্রমণের কারণে যশোরে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান করা হয়নি। আবার গত বছর ও চলতি বছর পবিত্র রমজানের কারণে বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে এবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। জেলা প্রশাসন বলছে, নিরাপত্তা নিয়ে কোনও সংশয় না থাকলেও প্রস্তুতি থাকবে।
মঙ্গল শোভাযাত্রার পথিকৃৎ শিল্পী ভাস্কর মাহবুব জামাল শামীমের হাতেগড়া সংগঠন চারুপীঠের শিল্পীরা বৈশাখ বরণে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। শহরের পৌর পার্কে সংগঠনের কার্যালয়ে শিল্পীরা বৃহদাকার টেপা পুতুল, ফুল-পাখি-পশুর মুখোশসহ নানা অনুষঙ্গ তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন।
এস এম সুলতান ফাইন আর্ট কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তৈরি করছেন বিশাল আকৃতির হাতি-ঘোড়া। এ ছাড়া বিভিন্ন মুখোশ ও সরা চিত্র।
ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন বিবর্তন যশোর রমজানের কারণে তাদের মূল অনুষ্ঠান ছোট করেছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর বিশ্বাস বলেন, সকালে আমাদের সংগঠনের কার্যালয়ে কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান রয়েছে। এরপর টাউন হল মাঠে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠানে অংশ নেবো।
ব্যাপক আয়োজনে নববর্ষ বরণে যশোরের ঐতিহ্য বহুকাল থেকে। করোনার কারণে ১৪২৭ ও ১৪২৮-তে মানুষ ছিল ঘরবন্দি। ১৪২৯ সালে রমজান মাস হওয়াতে ছোট পরিসরে বরণ করা হয়। এবারও রমজানের মধ্যে পহেলা বৈশাখ আসায় দুপুরের মধ্যে সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের। ছোট পরিসরে হলেও বর্ষ বরণের উৎসবে মাততে প্রস্তুত সবাই।
এবারও ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দান থেকে সকাল ৯টায় বের হবে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শোভাযাত্রা হবে। যশোরের ৩০টির বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রায় ৫০০ সাংস্কৃতিক কর্মী উৎসবকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উদীচী, পুনশ্চ, তীর্যক, চাঁদের হাটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে চলছে গান, নাচ, নাটক ও গীতিনাট্যের মহড়া। মঙ্গল শোভাযাত্রার হাতি, ঘোড়া, নৌকা, দোয়েল, কচ্ছপ, বড় আকৃতির সাপ, কুমির, বাঘ, পুতুলসহ নানা রঙের মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত চারুশিল্পীরা। এসএম সুলতান ফাইন আর্ট কলেজ, চারুপীঠ এবং চারুতীর্থসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীদের তুলির রঙিন আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠছে শোভাযাত্রার এসব অনুষঙ্গ।
চারুপীঠের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে, এই যশোরেই। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহবুব জামাল শামীম তার দুই সহপাঠীকে নিয়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন চারুপীঠ। এই প্রতিষ্ঠানই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার। এর চার বছর পরই ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, যা পরে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। সামনে নববর্ষ উপলক্ষে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য শোভাযাত্রার নৌকা, দোয়েল, কচ্ছপ, বড় আকৃতির সাপ, কুমির, বাঘ ও পুতুলসহ নানা রঙের মুখোশ তৈরি করা হয়েছে।
এসএম সুলতান ফাইন আর্ট কলেজের প্রভাষক গৌতম বিশ্বাস বলেন, ‘বাংলা বর্ষবরণে আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। পহেলা বৈশাখে আমাদের শোভাযাত্রা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে স্বল্প পরিসরে বের হলেও মূল শোভাযাত্রা যশোর টাউন হল থেকেই হবে।’
তীর্যক যশোরের সাধারণ সম্পাদক দিপঙ্কর দাস রতন বলেন, ‘নববর্ষকে ঘিরে যশোরের যে ঐতিহ্য নিমন্ত্রণপত্র সেটি ইতোমধ্যে বিলি করা শুরু করেছি। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তির মহড়া চলছে।’
এবারও পৌর উদ্যানে সকাল ৭টা ১ মিনিটে উদীচী যশোরের আয়োজনে হবে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব বলেন, উদীচী ১৯৭৩ সাল থেকে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করে আসছে। প্রায় এক মাস ধরে আমাদের মহড়া চলছে, প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন।
উদীচী হত্যাকাণ্ডের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও বিচার না হওয়ায় এবারের নববর্ষ উৎসবের স্লোগান দেওয়া হয়েছে, ‘বৈশাখের এই তীব্র দহনকাল-ছিন্ন করুক বিচারহীনতার জাল’।
সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরবিতান সংগীত একাডেমি যশোরের উদ্যোগে সকাল সাড়ে ৬টায় ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানের শতাব্দী বটমূলের রওশন আলী মঞ্চে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ স্লোগানকে সামনে রেখে নববর্ষকে আহ্বান জানানো হবে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বিশ্বাস জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও ভিন্ন আঙিকে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো হবে; সেই লক্ষ্যে একাডেমির শিক্ষার্থী শিল্পীদের সমন্বয়ে মহড়া চলছে।
পুনশ্চ যশোরের সাধারণ সম্পাদক পান্না দে বলেন, যশোর মুসলিম একাডেমি স্কুলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে শিশু, কিশোর এবং বড়দের ক্যাটাগরিতে সাজানো হয়েছে। এবার আমাদের অনুষ্ঠানের চমক হিসেবে থাকছে ‘চোতে সঙ’। মোদ্দাকথা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আমাদের সার্বিক আয়োজনে।
বর্ষবরণের আয়োজন উপলক্ষে জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, রাজধানীর বাইরে বর্ষবরণে সবচেয়ে বড় উৎসব যশোরেই হয়। রমজানের কারণে আমাদের অনুষ্ঠান সীমিত হলেও জেলার চারটি বড় ভেন্যুতে বর্ষবরণের উৎসব হবে। যশোর টাউন হল মাঠ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে। যশোরের সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন, সামাজিক, রাজনৈতিক পেশাজীবীসহ প্রশাসনের সবস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশ নেবেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্বাধিক নান্দনিক করতে এবারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায় নান্দনিক উপস্থাপন’ অনন্য মানসম্পন্ন এমন ১০টি সংগঠনকে এবার পুরস্কৃত করা হবে।
জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম বলেন, গত বছর এবং এই বছর রমজানের মধ্যে পহেলা বৈশাখ পড়ায় রমজানের পবিত্রতা রক্ষা অপরদিকে বৈশাখ বরণের যে আনন্দ, দুটি সমন্বয় করে পালন করা হচ্ছে। তার আগে দুই বছর আমরা করোনার কারণে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সেভাবে করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বোধ করছি না। তারপরও নিরাপত্তা নিয়ে যে সতর্কতা ও ব্যবস্থা আছে, তা যথেষ্ট। পুলিশ, র্যাব ও সরকারি সব বাহিনী প্রস্তুত থাকবে। আমরা ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ করবো।’