সুন্দরবনের বাঘ কেন নদীতে?

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর পর্যটক ও বনজীবীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন। নিষেধাজ্ঞার ফলে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিতে ফিরেছে নতুন স্পন্দন। এরই মধ্যে ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের তিনটি স্থানে তিনটি বাঘকে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালীতে একটি, ৩ সেপ্টেম্বর বিকালে কটকায় একটি একই দিন বিকালে আলীবান্দা এলাকায় নদীতে একটি বাঘকে সাঁতার কাটতে দেখেন বনকর্মী এবং পর্যটকরা। তবে কচিখালী ও কটকায় আগে বাঘ দেখা গেলেও আলীবান্দা এলাকায় এটাই প্রথম। এসব কারণে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কেন কুমিরের রাজ্যে সাঁতার কাটছে বাঘেরা? কারও কারও প্রশ্ন, সুন্দরবনে কি খাবারের সংকট?

এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মো. মহসীন হোসেন। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনে খাবারের কোনও সংকট নেই। ২০০৫-২০০৬ সালে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গতিবিধি জানতে বাঘের গলায় রেডিও কলার বসিয়ে গবেষণা করেছিলাম। গবেষণায় দেখেছি, বাঘ তার নির্দিষ্ট টেরিটোরিতে (এলাকায়) প্রতিদিন টহল দেয়। এটি রুটিন ওয়ার্ক। অনেকটা নির্দিষ্ট এলাকায় পাহারা দেওয়ার মতো। নিয়মিত টহল দেওয়ার কারণে বাঘের এলাকার নদী, খাল কিংবা বনাঞ্চল দেখার সুযোগ নেই কারও। ওই সময় সুন্দরবনের একটি বাঘের টেরিটোরি পাওয়া যায় ১৭ বর্গমাইল। নিজের এই এলাকায় দিনে একবার টহল দেয়। টেরিটোরিতে নদী কিংবা খালবিল যাই পড়ে, সেটিতে টহল দেয়। নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে নদী ও খালে নেমে পড়ে বাঘ। পর্যটক কিংবা বনরক্ষীরা যেহেতু নদীতে বেশিরভাগ সময় চলাচল করেন, তাই বাঘকে সাঁতরাতে দেখেন। পর্যটক কিংবা বনরক্ষীরা গহীন বনে যেতে পারেন না, ফলে বিভিন্ন সময়ে বনের আশপাশের এলাকায় বাঘ দেখতে পান।’

নদী পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসিংহ আর বাঘের চলাচল এবং আচরণে পার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করে ড. আবু নাসের বলেন, ‘চার-পাঁচটি কিংবা তারও বেশি সিংহ একসঙ্গে চলাফেরা করে। কিন্তু বাঘ তার নির্দিষ্ট টেরিটোরিতে একটাই থাকে। কোনও বাঘ নির্দিষ্ট টেরিটোরির বাইরে যায় না, আবার অন্য টেরিটোরির বাঘ আরেক বাঘের টেরিটোরিতে আসে না। টহলরত অবস্থায় মূত্রত্যাগ করে টেরিটোরি চিহ্নিত করে রাখে। মূত্রত্যাগের গন্ধে বাঘেরা বুঝতে পারে নিজের গণ্ডি। যেমন কটকার বাঘ কচিখালীতে যাবে না, আবার কচিখালীর বাঘ কটকায় আসবে না।’

এর আগে ৮ আগস্ট শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী অভয়ারণ্য কেন্দ্রের সামনে দেখা মিলেছে একটি বাঘের। বাঘটি বনরক্ষীদের ব্যারাকের খুব কাছে চলে আসে। এ সময় মোবাইলে বাঘটির ভিডিও ধারণ করেন এক বনরক্ষী।

ড. আবু নাসের আরও বলেন, ‘খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের বেশিরভাগ এলাকায় ক্যামেরা স্থাপনের পর নতুন নতুন এলাকায় বাঘ দেখা গেছে। তবে যেসব স্থানে সম্প্রতি বাঘ দেখা যাচ্ছে, ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত ওসব স্থানে বাঘ দেখা যায়নি। হয়তো চলাচলের টেরিটোরি আরও বাড়িয়েছে বনের বাঘগুলো।’

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শেখ মাহবুব হাসান বলেন, ‘বনরক্ষীরা টহলরত অবস্থায় ৩ সেপ্টেম্বর আলীবান্দা ট্যুরিজম এলাকায় একটি বাঘকে সাঁতার কাটতে দেখে ভিডিও ধারণ করেন। এর আগে কচিখালী ও চান্দেশ্বর এলাকায় বাঘ দেখা গেছে। তবে এর আগে কখনও আলীবান্দা ট্যুরিজম এলাকায় বাঘ দেখা যায়নি। এবারই প্রথম দেখা গেছে। হয়তো এটি নতুন টেরিটোরি।’

নদী বেষ্টিত সুন্দরবনবন বিভাগ বলছে, জুন থেকে আগস্ট—এই তিন মাস সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম। তাই এই সময়ে কাউকে বনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে এ সময়ে বাঘসহ বন্যপ্রাণীরা নিজেদের মতো স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করেছে। নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর পর্যটক ও বনজীবীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন। এ অবস্থায় অবাধ বিচরণ কমবে বন্যপ্রাণীদের।

বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবন বর্তমানে ১১৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে; যা ২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে ধরা পড়েছিল। ২০১৫ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে বাঘ শনাক্ত হয়েছিল ১০৬টি। বনে বর্তমানে দুই লাখ হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, সুন্দরীসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড ও ৩০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বনের অভ্যন্তরে ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জলভাগে কুমির, ছয় প্রজাতির ডলফিনসহ ২৯১ প্রজাতির মাছ রয়েছে। ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবনের বুক চিরে রয়েছে ৪০০ নদী-নালা এবং ২০০টি খাল। বাঘ, হরিণ, শূকরসহ ২৮৯ প্রজাতির স্থল ও জলজপ্রাণী রয়েছে। আছে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজপ্রাণী।

সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী লোকালয়নিষেধাজ্ঞার সময়ে বনে সব ধরনের প্রবেশ বন্ধ থাকায় জীববৈচিত্র্য আরও সমৃদ্ধ হয়েছে বলে জানালেন সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ‘বনের মধ্যে অসংখ্য নদ-নদী, খালে নিয়মিত পারাপার হয় বাঘ। তবে তা সবার চোখে পড়ে না। কারণ, বন্যপ্রাণী নিস্তব্ধতা পছন্দ করে। মানুষের উপস্থিতিতে এগুলো বনের গহীনে চলে যায়। দীর্ঘদিন মানুষের চলাচল না থাকায় বাঘ যে অবাধ বিচরণ করেছিল, এখন বাঘ দেখতে পাওয়ার ঘটনা থেকে তাই বোঝা যায়।’

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক ও এভারগ্রিন ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী মাঝহারুল ইসলাম কচি বলেন, ‘তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবন খুলে দেওয়া হয়। প্রথমদিনই ৯টি জাহাজে ৩৪৯ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে যান। ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে কচিখালী এলাকায় নদীতে একটি বাঘ ও ৩ সেপ্টেম্বর কটকা এলাকায় আরেকটি বাঘ দেখতে পান পর্যটকরা।’