সুন্দরবনের নদ-নদীতে ইলিশ নেই, গেলো কোথায়?

তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ইলিশ ধরতে সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা এবং পশুর নদীতে টানা ১৬ দিন জাল ফেলেছেন সঞ্জয় ফকির (৩৮)। এবার ধারদেনা করে জাল কিনেছিলেন। আশা করেছিলেন, নৌকাভর্তি করে ইলিশ আনবেন। কিন্তু আশানুরূপ মাছ না পেয়ে সব কষ্টই বৃথা গেলো। এখন মহাজনের দেনা পরিশোধ নিয়ে ‍দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে এই জেলের। সেইসঙ্গে সংসার চালানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।

সঞ্জয় ফকির মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের কানাইমারী গ্রামের বাসিন্দা। ছয় সদস্যের পরিবার তার। শুধু সঞ্জয় ফকির নন, কানাইমারী গ্রামের শিমুল বিশ্বাস, সাইমন সরকার, টিটো বাড়ৈ, করিম ফকির, মিল্টন বিশ্বাস ও অসিম মন্ডলেরও একই অবস্থা। স্ত্রীর গয়না বিক্রি, মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর টাকা নিয়ে নদীতে ইলিশ ধরতে গিয়েছিলেন তারা। দুই-চারটার বেশি কারও জালে ধরা পড়েনি ইলিশ। সবাই এখন দেনা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

মোংলার প্রধান বাজার সংলগ্ন নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর পাড়ে অনেক জেলে বসে আছেন। কেউ মাছ ধরতে জাল নিয়ে নামছেন। আবার কেউ জাল ফেলে তেমন মাছ না পেয়ে নদীর পাড়ে বসে আছেন। নিষেধাজ্ঞা শেষে যেখানে জালভর্তি মাছ পেয়ে মুখে হাসি থাকার কথা, সেখানে বসে দুশ্চিন্তা করছেন জেলেরা। কারণ নদীতে ইলিশ শিকারের আয়োজনে তাদের খরচের টাকাই উঠছে না।

জাল ফেলেও মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা

‌সঞ্জয় ফকির, ‘গত ১৬ দিন ধরে নদীতে জাল ফেলে মাত্র চারটি ইলিশ পেয়েছি। এই মাছ বিক্রি করে কীভাবে মহাজনের দেনা দেবো, কীভাবে সংসার চালাবো; কিছুই বুঝতেছি না। স্ত্রী-সন্তানের খাবারও জোগাতে পারবো না। কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’

কেন ইলিশ নেই?

শিমুল বিশ্বাস, সাইমন সরকার ও টিটো বাড়ৈ জানালেন, সুন্দরবনের কোনও নদ-নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না। হাজার হাজার টাকা খরচ করে দিনের পর দিন মোংলা এবং পশুর নদীতে জাল ফেললেও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। এর মূল কারণ জেলে নামধারী একদল দুর্বৃত্ত প্রতিনিয়ত বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদীতে মাছ শিকার করছে। ফলে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। যা আগে কখনও ছিল না।

একই কথা বলেছেন মোংলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি বিদ্যুৎ মন্ডল। তিনি বলেন, ‘বিষ প্রয়োগের কারণে এখন ইলিশশূন্য সুন্দরবনের সবগুলো নদ-নদী। বিষের গন্ধে এসব নদ-নদীর পানি মুখে নেওয়া যায় না। কয়েক বছর আগেও জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। কিন্তু গত দুই-তিন বছর ধরে মাছের আকাল। বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ফলে নদ-নদীর সব মাছ মরে যাচ্ছে। বিশেষ করে মা মাছ ডিম ছাড়লেও পোনা তৈরি হয় না। পাশাপাশি কোনও মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বিষ প্রয়োগ বন্ধ না হলে ইলিশ কেন, সুন্দরবনের নদ-নদীতে কোনও মাছ পাওয়া যাবে না। ফলে জেলেদের না খেয়ে থাকতে হবে।’

বিষ দিয়ে মাছ শিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেব বলেন, ‘আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে একশ্রেণির অসাধু জেলেরা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে বন বিভাগ। যেসব জেলে এর সঙ্গে জড়িত তাদের আটক করা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে জরিমানাও করা হচ্ছে। এরপরও এটি বন্ধ হচ্ছে না।’

বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, জীবজন্তু ও মাছের প্রজনন বাড়ানোর জন্য গত ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে ৯২ দিনের জন্য নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গত ১ সেপ্টেম্বর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবনসহ মোংলা উপকূলে ছয় হাজার ৬৯৫ জন নিবিন্ধিত জেলে রয়েছেন। এসব জেলে নদ-নদী ও সমুদ্রে ৯২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে মাছ ধরতে নামেন। কিন্তু মৌসুমের প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত আশানুরূপ ইলিশ না পাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলেরা।

নদীতে ইলিশ শিকারের আয়োজনে তাদের খরচের টাকাই উঠছে না

মোংলা মৎস্য সমিতির সভাপতি আফজাল ফরাজি বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে নদী ও সমুদ্রে ইলিশের দেখা মিলছে না। বলা যায় নদী প্রায় ইলিশশূন্য। মাছ না পাওয়ায় জেলেরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। স্থানীয়দের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন স্থান থেকে চড়া দামে ইলিশ এনে মোংলা বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।’

মৎস্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, বিশ্বে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। দেশে যে পরিমাণ ইলিশ আহরিত হয়, তার পাঁচ ভাগের একভাগ সুন্দরবনের নদ-নদীতে পাওয়া যায়। কিন্তু জেলেরাই বিষ প্রয়োগ করে ধ্বংস করছে ইলিশের পোনা এবং ছোট মাছ। এজন্য মাছের আকাল।

এ বিষয়ে মোংলা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদীতে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ডিম ছাড়ার পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় মা ইলিশ গতিপথ পরিবর্তন করে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। যে কারণে সুন্দরবনের নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু ইলিশ নয়; বিষমিশ্রিত পানিতে অন্য মাছের প্রজনন বিঘ্নিত হয়। তাই সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করতে হবে জেলেদের। তাদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি আমরা। সেইসঙ্গে আইন প্রয়োগ করছি।’