বেঁচে যাওয়া সিরাজুল ইসলাম এই পাঁচ শহীদের আত্মত্যাগ মনে রাখার জন্য হরিহর নদীর পাশের সমাধিটিকে স্মৃতিসৌধ করার দাবি জানিয়েছেন।
সিরাজুল ইসলাম জানান, তার ছোট চাচা রফিক তখন ছাত্র ইউনিয়ন যশোরের অভয়নগর থানা কমিটির সেক্রেটারি। বাড়িতে ওই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মাঝেমধ্যে আশ্রয় নিতেন। সেই সুবাদেই ওই পাঁচ শহীদের সংস্পর্শে আসেন সিরাজুল।
১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর যশোরের মণিরামপুর উপজেলার চিনেটোলায় রাজাকার বাহিনীর হাতে যে ছয় মুক্তিযোদ্ধা আটক হন, সিরাজুল ইসলাম ছিলেন তাদেরই একজন। কৌশলে পালিয়ে জীবন রক্ষা হয় তার। তবে, রাজাকারদের নির্মম নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয় সেদিন পাঁচ সূর্যসন্তানদের।
৭১’ এর উত্তাল দিনগুলির কথা স্মরণ করে সিরাজুল বলেনন, একাত্তরের যুদ্ধের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (ইপিসিপি) কর্মীরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে যশোর এবং খুলনা জেলা কমিটি হানাদারদের সঙ্গে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তারা মাগুরার শালিখা থানার পুলুম ও খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায় ঘাঁটি গড়ে তোলেন।
যুদ্ধের শুরুতেই তারা থানা ও ফাঁড়ি লুট করে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যশোর-খুলনার বেশ কিছু এলাকা শত্রুমুক্ত করেন।ৱ
যুদ্ধের এক পর্যায় ১৯৭১ সালের অক্টোবরের দিকে ডুমুরিয়া এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাত্রা করেন তোজো, শান্তি, মানিক, আসাদ, ফজলু ও সিরাজুল। পথে মণিরামপুর উপজেলায় রাতে আব্দুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। তবে হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারদের চোখ এড়াতে পারেননি।
স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার আব্দুল মালেক ডাক্তারের নেতৃত্বে মেহের জল্লাদ, ইসাহাক, আব্দুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন রাজাকার চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তাদের। এরপর চোখ বেঁধে চিনাটোলা বাজারের পূর্বপাশে হরিহর নদীর তীরে নিয়ে যায়। এরপর তাদের শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে লবণ দেওয়া হয়। এভাবে অমানসিক নির্যাতন চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
সেই টিমের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য সিরাজুল ইসলাম। ১৯৫২ সালে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামে তার জন্ম। দুই মেয়ে সন্তানের জনক সিরাজুল নওয়াপাড়া জুট মিলে মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিদর্শক পদে কর্মরত রয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট না নেওয়া সিরাজুল ইসলাম চান, একাত্তরের বীরযোদ্ধা আসাদসহ পাঁচজনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তিনি বলেন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন জনগণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর সেইসব বীরসেনানীকে চিরকাল মনে রাখতে হরিহর নদীর পাশে তাদের সমাধিটিকে স্মৃতিসৌধ করার উচিত।
শহীদ হওয়া পাঁচজনের মধ্যে মাশফিকুর রহমান তোজো ১৯৬১ সালে গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি লন্ডন থেকে অ্যাকচুয়ারি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে কৃষকদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।
আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন যশোর এমএম কলেজের ভিপি, ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতা। ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনের আহ্বায়কও ছিলেন আসাদ।
সিরাজুল ইসলাম শান্তি ছিলেন জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।
আহসানউদ্দিন খান মানিক ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের জেলা শাখার সভাপতি। তাদের সবার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।
আর ফজলুর রহমান ফজলু সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি ওইসময় সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে আসাদ-তোজোদের সঙ্গে একাত্ম হন। এরপর সব লড়াইতে তিনি তাদের সঙ্গেই ছিলেন।
/এনএস/টিএন/