সড়কে মায়ের পেট ফেটে জন্ম নেওয়া সেই ফাতেমা ভালো আছে

ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাক চাপায় মায়ের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে পেট ফেটে জন্ম নেওয়া সেই শিশু ফাতেমা সমাজসেবা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ঢাকার আজিমপুরের ছোট মনি শিশু নিবাসে আদর যত্নে বেড়ে উঠছে। প্রতি শনিবার দাদা, দাদি ও বোন জান্নাতুল ফেরদৌস ফাতেমাকে দেখে আসেন।

ফাতেমার ভাই এবাদত ও জান্নাতুল ফেরদাউসকে গ্রামের বাড়িতেই লালন পালন করছেন দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু এবং দাদি সুফিয়া খাতুন।

ত্রিশালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একই  পরিবারের তিন জন নিহত হওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। পরিবারটিকে আর্থিক সাহায্য দিতেও এগিয়ে আসেন অনেকে।

হাইকোর্টের নির্দেশে সরকারিভাবে বাংলাদেশ রোডস ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিবারটিকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়।

বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। আর্থিক সহযোগিতার জন্য ত্রিশাল উপজেলার ইউএনও এবং ফাতেমার দাদা মুস্তাফিজুর রহমান বাবলুর যৌথ নামে সোনালী ব্যাংকে একটি হিসাব খোলা হয়েছে। বিআরটিএ ট্রাস্ট কর্তৃক দেওয়া পাঁচ লাখ টাকাসহ বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের হিসাবে জমাকৃত অঙ্কের পরিমাণ ১২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

ফাতেমার দাদা মুস্তাফিজুর রহমান বাবলু বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আমার পুত্র জাহাঙ্গীর, পুত্রবধূ এবং ছয় বছরের নাতনি ঘটনাস্থলে মারা যায়। এ সময় মায়ের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে পেট ফেটে জন্ম নেয় শিশু ফাতেমা। তিন জনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিবারটি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। আমার ছোট্ট চায়ের দোকান এবং জাহাঙ্গীরের আয় রোজগার দিয়ে সংসার চলতো। তবে এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সহানুভূতি, ভালোবাসা এবং সাহায্য নিয়ে মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে এতিম ফাতেমা সমাজসেবার তত্ত্বাবধানে ঢাকার আজিমপুরে ছোটমনি নিবাসে বড় হয়ে উঠছে। আর অপর দুই নাতি-নাতনি জান্নাতুল ফেরদৌস ও এবাদুল্লাহ গ্রামের বাড়িতে আমাদের সঙ্গে থাকছে। জান্নাতুল ফেরদৌসকে চতুর্থ শ্রেণিতে এবং এবাদুল্লাহকে প্রথম শ্রেণিতে ত্রিশালে রায় মনির আনোয়ারা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হয়েছে।’

তিনি জানান, রিপন নামের স্থানীয় একজন সমাজসেবী এই দুই জনের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। তবে মা-বাবার শোক জান্নাত আর এবাদুল্লাহ ভুলতে পারে নাই। তারা স্কুল থেকে এসে বই খাতা রেখে মা-বাবার কবরের পাশে দীর্ঘ সময় বসে থাকে। ফাতেমা কিছুটা বুঝতে চাইলেও এবাদত কিছুই বুঝতে চায় না।

তিনি বলেন, ‘আমার ছোট্ট চায়ের দোকান। সেই দোকানের মালামাল তেমন নাই। পান, চা, বিস্কিট বিক্রি করে যা আসে তাই সংসারের খরচে লাগানো হয়। কিন্তু এই আয় দিয়ে সংসার চলছে না। সরকারিভাবে এবং মানুষের দেওয়া সাহায্যের অ্যাকাউন্ট থেকে এখন পর্যন্ত বাড়ির ঘরের চালা বদলানোর জন্য ২০ হাজার টাকা উঠানো হয়েছে। বাকি টাকা এখনও ব্যাংকে রয়েছে।

জান্নাতুল ফেরদৌসী জানায়, মা-বাবা আর ছোট বোনের মুখ এখনও তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কোনওভাবে তাদের ভুলতে পারে না সে।

আক্ষেপ করে জান্নাতুল ফেরদৌসী বলছিল, মা-বাবার আদর থেকে আমরা তিন ভাইবোন একেবারেই বঞ্চিত হয়েছি। ফাতেমা তো মা-বাবাকে দেখতেই পারলো না। জন্মের সময়ই তাদের হারালো। তবে আমরা মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। অনেকেই বাড়িতে এসে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।

লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে চায় জানায় জান্নাত।

ত্রিশালের উপজেলা নির্বাহী অফিসার আখতারুজ্জামান জানান, বিআরটিএ ট্রাস্ট এবং বিভিন্ন সংস্থা ও মানুষের সাহায্য সহযোগিতার টাকা সোনালী ব্যাংকে রাখা আছে। এই টাকা কোনওভাবে নষ্ট করা যাবে না। তিন এতিম শিশুর লেখাপড়াসহ লালন-পালনের জন্য এই টাকা ব্যয় করা হবে।

উল্লেখ্য, গত ১৬ জুলাই ত্রিশালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পারাপারের সময় ট্রাকচাপায় রায়মনি গ্রামের জাহাঙ্গীর, তার স্ত্রী  ও তাদের ছয় বছরের মেয়ে নিহত হয়। এ সময় ট্রাকচাপায় অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে পেট ফেটে এক মেয়ে সন্তান জন্ম দেন। উপজেলার কোর্ট ভবন এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। শিশুটির নাম রাখা হয় ফাতেমা। পরে শিশুটিকে সমাজসেবা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর আজিমপুরে অবস্থিত ছোটমণি নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।