আত্রাইয়ের পানি বিপদসীমার ১০০ সে.মি. ওপর, নতুন এলাকা প্লাবিত

নাটোরের সিংড়ায় আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টি মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে এই তথ্য জানিয়েছেন নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশু শেখর রায়। এদিকে নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়তই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাড়ছে বানভাসি মানুষের সংখ্যা।

ইতোমধ্যেই আত্রাই নদীর পানি আর সিংড়া বিলের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নাটোর-বগুড়া মহাসড়কে পানি উঠতে শুরু করেছে। নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে বিলের পানি। এর ফলে ভেসে গেছে মাছ চাষের সব পুকুর, ডোবা আর জলাশয়। এতে মাছ চাষিদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৯ কোটি টাকা। অপরদিকে পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে গবাদি পশু আর হাঁস-মুরগির খাবার। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা।

এদিকে নদীর পানি বৃদ্ধি আর এলাকা প্লাবিত হওয়ার নির্ঘুম রাত কাটছে সিংড়া এলাকার মানুষের। মাঝে মাঝেই নতুন নতুন রাস্তা আর নদীর তীর এবং বাঁধে ফাটল আর এলাকা প্লাবিত হওয়ার সংবাদে জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে এসব মানুষ। তাদের মধ্যে সবসময় আতঙ্ক বিরাজ করছে।natore-2

তবে জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে । এখানে বারনই নদীর পানি বিপদসীমার ৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশু শেখর রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে সিংড়ার আত্রাই নদীর পানির পরিমাণ ১৩.৬৫ মিটার যেখানে নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে নলডাঙ্গা উপজেলার বারনই নদীর পানি১৩.৪৫ মিটার যেখানে নদীর পানি বিপদসীমার ৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।’

সরেজমিনে সিংড়া ও নলডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সিংড়ায় আত্রাই নদী এবং বিলের পানির তীব্র স্রোত। এই পানি পৌঁছে গেছে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ফুটপাথ পর্যন্ত। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পানি। বিভিন্ন সড়ক আর নদীরক্ষা তীর ও বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল।natore-5

সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন জানান, আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে গত ২৪ ঘন্টায় সিংড়া উপজেলা এলাকায় নতুন করে ১ হাজার ৪২০হেক্টর আবাদি জমি সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। বর্তমানে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৭ হাজার ৭০১ হেক্টর। অপরদিকে নতুন করে আংশিক তলিয়ে গেছে ২২৫ হেক্টর জমি। বর্তমানে এই আংশিক তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর।

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল আহসান জানান, মঙ্গলবার দুপুরে সিংড়া পৌর এলাকার ৮নং ওয়ার্ডের সরকারপাড়ায় আত্রাই নদীর তীর কিছু অংশ ধসে যাওয়ায় সরকারপাড়া প্লাবিত হয়। এসময় গ্রামে তীব্র স্রোত আকারে পানি প্রবেশ করলে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। স্থানীয় লোকজন তাদের বাড়ির প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকেন। খবর পেয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জুনাইদ আহমেদ পলক,লালপুর-বাগাতিপাড়া আসনের সাংসদ অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ, পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌসসহ উপজেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। এসময় সরকারপাড়ার প্রায় ৪০০ পরিবারের মধ্যে প্রায় ৫০টি পরিবারকে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে স্থানান্তর করা হয়।natore-3

নাজমুল আহসান আরও জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সিংড়া এলাকায় নতুন করে ৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২০টি।

এক প্রশ্নের জবাবে নাজমুল আহসান জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নতুন করে পানি প্রতিরোধ সম্ভব নয়, কারণ সব এলাকা প্লাবিত হওয়ায় বালি পাওয়া যাচ্ছে না আর পাওয়া গেলেও তা গাড়িতে করে বহন করা সম্ভব হচেছ না। উপজেলার সব এলাকা পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছ চাষিরা।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আতাউর রহমান খাঁন জানান, বন্যা আর অতিবৃষ্টির কারণে জেলার সিংড়া,নলডাঙ্গা আর গুরুদাসপুর উপজেলার মাছচাষি ও খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, জেলার এই তিন উপজেলায় মোট ৯৭৬ জন মাছ চাষির ৬০০ হেক্টর আয়তনের ১ হাজার ৭৫১টি পুকুর ও মাছ চাষক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছ চাষিদের প্রায় ২ হাজা ৮১ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে যার বাজার মূল্য প্রায় ২৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে সিংড়া উপজেলায় ৫২০ হেক্টর আয়তনের ১ হাজার ৫০০টি পুকুরের ১ হাজার ৯২৬.০৬ মে.টন মাছ ভেসে গেছে। এর বাজার মূল্য প্রায় ২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা।natore-6
অপরদিকে মাছ চাষ ক্ষেত্রের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা। এদিকে নলডাঙ্গা উপজেলায় মোট ৫৫ হেক্টর আয়তনের ১৮০টি পুকুর ও মাছ চাষ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মাছের পরিমাণ প্রায় ১৫০ মে.টন যার বাজার মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। এছাড়া অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। অপরদিকে গুরুদাসপুর উপজেলায় ২৬ হেক্টর আয়তনের ৭১টি মাছ চাষক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ৪ মে.টন মাছ ভেসে গেছে যার বাজার মূল্য প্রায় ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলতাব হোসেন জানান, বন্য আর অতিবৃষ্টির কারণে জেলার সিংড়া,নলডাঙ্গা আর গুরুদাসপুর উপজেলায় মোট ৫ হাজার ৫৮০টি গবাদি পশু আর ১০ হাজার ১২১টি হাঁস-মুরগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে আলতাব হোসেন দাবি করেন, বন্যা আর অতিবৃষ্টির কারণে জেলায় মোট ৪৮ লাখ ৭৬ হাজার ২৩৭ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে ৬০মে.টন দানাদার খাদ্যের ক্ষতি হয়েছে যার বাজার মূল্য ২৫ লাখ ১০ হাজার ৪৩৭ টাকা,খড় ক্ষতি হয়েছে ৩৫০ মেটন যার বাজার মূল্য ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং উন্নত জাতের ঘাস ও সবুজঘাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯৭ মে.টন যার বাজার মূল্য ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০০ টাকা।

আলতাব হোসেন আরও জানান, বুধবার সিংড়া উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারি ও গবাদি পশু পালনকারীদের মধ্যে ১ মে.টন সবুজ ঘাস বিতরণ করা হবে। এই ঘাস বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এছাড়া আগামী ১৫ দিনের জেলার মোট দানাদার খাদ্য ও ঘাসের চাহিদা উর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই তা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।