সেদিন নওগাঁ শহরের আকালু নামে এক পাগল লর্ড লিটন ব্রিজের পূর্ব পাশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকলে তাকে সেখানেই ব্রাশফায়ার করা হয়। পরে যমুনা নদীতে তার লাশ নিক্ষেপ করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। অনুসন্ধানে জানা যায় সে চকবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। নওগাঁতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হাতে নিহত প্রথম শহীদ আকালু পাগল।
৭১ -এ এপ্রিল মাসে নওগাঁর যেসব স্থানে পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন ও গণহত্যা চালায় সেগুলো হচ্ছে
পার নওগাঁ মধ্যপাড়া বধ্যভূমি
২২ এপ্রিল ১৯৭১ পার নওগাঁ মধ্যপাড়ায় ভাড়ার বাড়িতে বসবাসরত কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর নিবাসী আব্দুর রাজ্জাকের পরিবারের পাঁচ জন সদস্যের মধ্য চার জনকে গলাকেটে হত্যা করে বিহারী সম্প্রদায়।
ধামকুড়ী বধ্যভূমি
ধামকুড়ী গ্রাম তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার অন্তর্গত হলেও গ্রামটি ছিল বগুড়া জেলার সীমানা রেখার সান্তাহারের কাছে। ১২ এপ্রিল ১৯৭১ দুপুর আনুমানিক ১টা । ছোট এই গ্রামটিকে দুই দিক থেকে হানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে। এ সময় গ্রামটি প্রায় জনমানব শূন্য, দু- একজন অসীম মনোবল ও বুকে সাহস বেঁধে বাড়িতেই ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম পুলিশ ইন্সপেক্টর সামসুদ্দিন সরদার। হানাদাররা তার বাড়ির সামনে এলে তিনি ইউনিফরম পরা অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন হাতে তার সাদা পতাকা। হানাদাররা তাকেসহ বাড়ির অন্য পুরুষদের বের করে এনে বাড়ির উঠানে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।
নওগাঁ পূর্ব পাড়া বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পার নওগা পূর্ব পাড়া বধ্যভূমিতে হানাদার বাহিনী পাঁচ জনকে গুলি ও গলাকেটে হত্যা করে। এই পাঁচ জনকে পার নওগাঁ পূর্ব পাড়ার বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখা হয়।
নওগাঁ স্টেডিয়াম বধ্যভূমি
২২ এপ্রিল বিকালে নওগাঁ স্টেডিয়াম মাঠের পূর্ব উত্তর কোণ ঘেঁষে কদম গাছের নিচে নিরীহ তিন বাঙালিকে হত্যা করে বিহারী সম্প্রদায়। পরে লাশগুলো দিঘিতে ফেলে দেয় ।
শেখপুরা বধ্যভূমি
২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার ও বিহারীদের সহায়তায় শেখপুরা গ্রামের কয়েকজনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
মহদেবপুর বাজিতপুর বধ্যভূমি
২৪ এপ্রিল ১৯৭১ সকাল ১০ টায় মহাদেবপুর থানার বাজিতপুর ও চকদৌলত গ্রাম দুই দিক থেকে ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী। ১২ জন নিরীহ জনগণকে সারিবব্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হত্য করে তারা । এদের মধ্য একজন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
এছাড়া এই মাসেই ফতেপুর, দোগাছি, আতাইকুলা, বান্দাইখাড়া, ধামুইরহাট, মান্দা পাকুরিয়া, পার বোয়ালিয়া, খাগরকুড়ী, বদল গাছীসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালি দালাল ও অবাঙালিদের নিয়ে গণহত্যা চালায়।
পরে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নওগাঁ হানাদার মুক্ত হয়। ওইদিন সকালে বগুড়া থেকে অগ্রসর মান ভারতীয় মেজর চন্দ্রশেখর ও পশ্চিম দিনাজপুর বালুর ঘাট থেকে দিকে অগ্রসরমান পি.বি. রায়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনীর তখন আর কিছুই করার ছিল না। তখন দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা নওগাঁ কে.ডি স্কুল থেকে পি.এম গার্লস স্কুল ও সরকারি গার্লস স্কুল থেকে শুরু করে পুরাতন থানা চত্বর ও এসডিও অফিস চত্বরের রাস্তার দুই ধারে মাটিতে অস্ত্র রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আত্মসমর্পণ করে। তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার এসডিও সৈয়দ মাগরুব মোর্শেদ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীকে স্বাগত জানান। নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে এসডিও অফিস চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা পতাকার প্রতি সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন।