বিএমডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. আবুল কাসেমের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের জন্য গোদাগাড়ী জোন-২ এর সহকারী কোষাধ্যক্ষ খাবিরুদ্দিন ও সহকারী হিসাবরক্ষক মতিউর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তারা আগুন লাগান। একইসঙ্গে এই দুই ব্যক্তির প্রতি নজরদারি না করে নিজ দায়িত্বে অবহেলা করেছেন তিন সহকারী প্রকৌশলী জিএফএম হাসনুল ইসলাম (বর্তমানে কর্মরত মোহনপুর জোনে), সৈয়দ জিল্লুর বারী (বর্তমানে কর্মরত গোদাগাড়ী জোনে) ও আনোয়ার হোসেন (বর্তমানে কর্মরত নওগাঁর আত্রাই জোনে)।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর গোদাগাড়ী জোন-২ এর হিসাব শাখার সহকারী কোষাধ্যক্ষ খাবিরুদ্দিনকে পাশের উপজেলা তানোর জোনে বদলির আদেশ দেওয়া হয়।দায়িত্বভার হস্তান্তরের বিষয় থাকায় বিভিন্ন নথিপত্র ধ্বংস করে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ওই আগুনের সূত্রপাত ঘটান তিনি। কারণ, তিনি বিভিন্ন সময়ে ১৫০টি চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৪ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৬ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেছিলেন। সুকৌশলে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে হিসাবরক্ষক মতিউর রহমানও ৯৮ হাজার টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেছিলেন। ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১২ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত গোদাগাড়ী জোনের দায়িত্বে ছিলেন সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন। তার মেয়াদে ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ০৯৭৮৪৫০ নম্বর চেকটির মূল টাকার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫৪ টাকা। এই চেকে স্বাক্ষর ছিল প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন ও হিসাবরক্ষক মতিউর রহমানের। তবে ১৫৪ (টাকা) সংখ্যার আগে ৮৯ বসিয়ে মোট ৮৯ হাজার ১৫৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। এতে ৮৯ হাজার টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করা হয়েছে বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এছাড়াও উচ্চ উপসহকারী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম ও সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের যৌথ স্বাক্ষরে ২০১২ সালের ২৮ জুন ০৯৭৯৩৭৯ নম্বরের চেকের মুড়িতে ১ হাজার টাকার চেকে লেখা ছিল ৩৮২ টাকা। যা কেটে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। মুড়িতে উল্লিখিত টাকার হিসাবে ৯ হাজার টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করা হয়েছে।
২০১২ সালের ৩০ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত গোদাগাড়ী জোন-২ এ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন জিএফএম হাসনুল ইসলাম। আগুন লাগার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির কাছে বর্তমানে মোহনপুরে জোনে কর্মরত সহকারী প্রকৌশলী জিএফএম হাসনুল ইসলাম জানান, দফতরের একটি কক্ষেই আগুন লেগেছে। এজন্য সহকারী কোষাধ্যক্ষ খাবিরুদ্দিনই দায়ী। ভ্যাট ও আয়কর জমা প্রদানের তথ্য সংক্রান্ত কোনও রেজিস্টার নেই। ফলে বিষয়টি রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু তদন্ত কমিটির জিএফএম হাসনুল ইসলামের বক্তব্যকে অসত্য বলেছেন। কারণ আগের সহকারী প্রকৌশলীদের সময়ে ২০০৯ সালের ২২ নভেম্বর থেকে ভ্যাট ও আয়কর জমা সংক্রান্ত রেজিস্টার খোলা হয়। সে রেজিস্টার ব্যবহার করে ভ্যাট ও আয়কর জমা মনিটর করেছেন।
২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ দিন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ জিল্লুর বারী। তদন্ত কমিটি জানতে পারে সৈয়দ জিল্লুর বারীর অতিরিক্ত সময়ে চেক জালিয়াতি করে ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ জিল্লুর বারী বলেছিলেন, ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইস্যুকৃত চেকটির (নম্বর-০৪৮৪৯৪১) মুড়িতে ১ হাজার ৯৪ টাকা হিসাবে আমার স্বাক্ষর রয়েছে এবং মূল চেকটিও ১ হাজার ৯৪ টাকা হিসাবে স্বাক্ষর করা হয়েছিল। কিন্তু খাবিরুদ্দিন অত্যন্ত সুকৌশলে মূল চেকে টাকার অঙ্কের সামনে ২ লিখে এবং কথায় এক হাজারের ১-কে একুশ লিখে একুশ হাজার চুয়ানব্বই টাকা করেছেন। তিনি ওই টাকা উত্তোলন করে এককভাবে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও খাবিরুদ্দিন বিভিন্ন সময়ে আদায়কৃত ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ টাকা জমা না করে আত্মসাৎ করেছেন।
২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কেন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার সন্তোষজনক ব্যাখা চেয়ে সাত কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাহী পরিচালক বরাবরে দাখিলের জন্য ব্যাখা তলব করেছিলেন বিএমডিএ সচিব সাইফুর রহমান খান। এ ব্যাপারে সাইফুর রহমান খান বলেন, ‘এ ঘটনার সমস্ত ফাইল আমি প্রধান নির্বাহী পরিচালকের দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি ব্যবস্থা নেবেন।’
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয়েছে কিনা, তদন্ত প্রক্রিয়ায় ধীরগতি কেন–এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন,‘আমরা ফৌজদারি মামলা করতে পারি না। তাই আমরা দুর্নীতি দমনকে বিষয়টি তদন্ত করে মামলা করার সুপারিশ করেছি। তবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে। কারণ, চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অতিরিক্ত অর্থ তাদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে।’
চেকগুলো ন্যাশনাল ব্যাংক গোদাগাড়ী শাখা থেকে ক্যাশ করেছিলেন কোষাধ্যক্ষ খাবিরুদ্দিন ও হিসাবরক্ষক মতিউর রহমান। এ ব্যাপারে ব্যাংকের ম্যানেজার কিশোর কুমার সরকার বলেন,‘আমি গত ডিসেম্বরে এই শাখায় যোগদান করেছি। আগে থেকে এই বিষয়ে কোনও তদন্ত হয়ে থাকলে আমার নজরে থাকতো। কিন্তু এ ধরনের কোনও তথ্য আমার জানা নেই।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত সহকারী হিসাবরক্ষক (বর্তমানে রংপুরের মিঠাপুকুর জোনে আযুক্ত) মতিউর রহমান বলেন, ‘অফিসের প্রয়োজনে অতিরিক্ত টাকা খরচ করা হয়েছিল। ওই টাকা সমন্বয় করার জন্য অনিয়ম করে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। কারণ বাজেট ছিল না। বিষয়টি তখন আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানতেন। অভ্যন্তরীণ ও বাণিজ্যিক অডিট সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখন তারা অস্বীকার করছেন। আমার শুনানি হয়েছে। তবে শুনানিকালে ৮৯ হাজার ১৫৪ টাকার কথা লিখিত নেওয়া হলেও বিভাগীয় মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার ৪৭৬ টাকা। যা বিধি পরিপন্থী। লিখিতভাবে আমার কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা অফিস থেকে চাওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে আমাকে এ অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখেছে। ভুলত্রুটি হলেও তো এর সমাধান আছে। এর সমাধান চাই।’
আরেক অভিযুক্ত সাময়িক বরখাস্ত ও রাজশাহী রিজিয়নে আযুক্ত সহকারী কোষাধ্যক্ষ খাবিরুদ্দিনের মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করলেও তিনি তা ধরেননি।