জয়পুরহাট চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, ৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ থেকে ৩ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গত ২১ ডিসেম্বর থেকে আখ মাড়াই শুরু করে জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষ। বুধবার (৬ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত আখ মাড়াই হয়েছে ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। যা থেকে চিনি উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৭৫৩ মেট্রিক টন। বাকি রয়েছে এক হাজার ৪৯৭ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন আখ সরবরাহ কম হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও কমে গেছে। ফলে এবার ৪ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের আশা করছেন কর্তৃপক্ষ।
সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য জেলার প্রায় সাড়ে তিন হাজার আখচাষির কাছ থেকে প্রায় ১৪ কোটি টাকার আখ কেনা হয়েছে। যার মধ্যে শুরুর দিকে ৩ কোটির মতো টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। পাওনা রয়েছে এখনও প্রায় ১১ কোটি টাকা। আখের মূল্য পরিশোধের দাবিতে গত সোমবার (৪ ফেব্রুয়ারি) জয়পুরহাটের চিনিকল চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন আখচাষিরা। পরে তারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দেন। এই টাকা পরিশোধের জন্য কর্তৃপক্ষ দিনের পর দিন আশ্বাস দিলেও গত এক মাসে টাকা না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। সময়মতো টাকা না পাওয়ায় আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা।
এদিকে, এই চিনিকলের প্রায় এক হাজার শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা গত তিন মাস ধরে বেতন না পেয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। বেতনের নিশ্চয়তা না পেয়ে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে উত্তর জয়পুর গ্রামের আখচাষি মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম বলেন, ‘সাত ট্রাক্টর আখ দিয়েছি চিনিকলে। তারা ঋণের টাকা আগেই কেটে নিয়ে মাত্র ১১০০ টাকা পরিশোধ করেছে। এখনও ৪০ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরেও টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। নগদ টাকা খরচ করে আখ চাষ করতে হয়েছে। আখ বিক্রি করে যদি টাকাই না পাওয়া যায়, তাহলে চাষ করে লাভ কী।’
চিনিকলের কর্মচারী ও আখচাষি রমজান আলী বলেন, ‘প্রায় এক মাস হলো ১০ ট্রাক্টর আখ দিয়েছি চিনিকলে। ঋণ বাদ দিয়ে যেখান থেকে ৫০ হাজার টাকা আমার পাওনা রয়েছে। কিন্তু চিনিকল থেকে কোনও টাকাই দেওয়া হচ্ছে না। তিন মাস ধরে বেতনও বন্ধ। ছেলেমেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।’
চিনিকলের মিস্ত্রী নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যারা চিনিকলের কর্মচারী, তাদের জন্য আখ চাষ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেই সুবাদে নগদ টাকা খরচ করে আখচাষ করেও বিক্রির টাকা সময়মত পাওয়া যাচ্ছে না। আবার তিনমাস ধরে কোনও বেতনও পাচ্ছি না। এ অবস্থায় ছেলের পড়ালেখার খরচ চালানো তো দূরের কথা, সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিনিকলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মচারী অভিযোগ করেন, ‘শুধু কর্মচারীদের অবসরকালীন টাকার পরিবর্তে চিনি দেওয়া হচ্ছে। যে চিনি মোটা অঙ্কে বিক্রি করে অবসরের টাকা নিতে হচ্ছে। অথচ কর্মকর্তারা ঠিকই অবসর নেওয়ার পর টাকা পাচ্ছেন।’
শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব রুমেল বলেন, ‘গত তিন মাস থেকে চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারীদের কোনও বেতন দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি আখচাষিরাও আখ বিক্রি করে প্রায় এক মাস ঘুরেও টাকা পাচ্ছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে কেউ আখ চাষ করবেন না। এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ফারুক আখচাষিদের পাওনার বিষয়ে বলেন, ‘তাদের পাওনা ১১ কোটি টাকা পরিশোধ করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই সব টাকা পরিশোধ করা হবে। আর শিগগিরই শ্রমিক কর্মচারীদের বেতনের টাকা দেওয়ার বিষয়েও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।’
পরিচালক জিয়াউল ফারুক আরও বলেন, ‘দেশের বড় বড় বাজারে জয়পুরহাটের চিনির চাহিদা অনেক বেশি। গত মৌসুমের মাত্র একশ মেট্রিক টন চিনি গুদামে মজুদ আছে। আর এবার ৬০ হাজার মেট্রিক টন আখ থেকে ৪ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে সব সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।’