১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার। মা পলান নামে ডাকতেন। পাঁচ বছর বয়সে বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারকে হারান পলান। পরে নানা ময়েন উদ্দিন সরকার তাদের নিয়ে আসেন রাজশাহীর বাউসায়। সেখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির পর ইতি টানেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। তবে থেকে যায় বই পড়ার অভ্যাস। প্রথমে এর-ওর কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়তেন। নিজের অভ্যাস আশোপাশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পলান সরকার নিজ এলাকায় ‘বইওয়ালা দাদুভাই’, ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ নামে পরিচিত ছিলেন।
ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। অভিনয় করতেন ভাঁড়ের চরিত্রে। আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপও বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে তার।
ছয় ছেলে ও তিন মেয়ের জনক পলান সরকার। বাউসা বাজারের অদূরে গেদুর মোড় এলাকায় তার বাড়ি। বাড়ির পাশেই পাঠাগার। পাঠাগারজুড়ে থরে থরে সাজানো বই। পাঠাগারের একটি তাকে সাজানো পলান সরকারের যাবতীয় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামে-গ্রামে বই বিলি করে গেছেন তিনি। বিশেষ করে গৃহিণীদের বই পড়তে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার চেষ্টায় আলোকিত হয়ে উঠেছে বাউসার আশেপাশের অন্তত ২০ গ্রাম।অর্জন। মুগ্ধ পাঠকের অভিব্যক্তিও ঠাঁই পেয়েছে পলান সরকারের পাঠাগারে।
এভাবেই চা দোকানি থেকে শুরু করে গৃহবধূ সবাই তার পাঠকের তালিকায় চলে আসেন। বদলে যায় দৃশ্যপট। নিজের গ্রামে তার বাড়িটিই হয়ে ওঠে পাঠাগার। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। পলান সরকারকে সবার সামনে নিয়ে আসে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভিতে প্রচারিত ইত্যাদিতে তাকে তুলে আনা হয় আলোকিত মানুষ হিসেবে। আর ২০১১ সালে পান একুশে পদক।
পলান সরকার তার বই পড়ার আন্দোলনটাকে শুধু পাঠাগার কেন্দ্রিক না রেখে একটু অন্যভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আগে তিনি শুধু বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসতেন। পড়া শেষ হলে পুরোনো বইটা নিয়ে নতুন একটা দিয়ে আসতেন। কয়েক বছর থেকে তিনি বই বিতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করেন। এজন্য বাজারের বইপ্রেমী কোনও দোকানিকে তিনি বেছে নেন। দোকান মালিক তার দোকানে মালামালের পাশাপাশি পলান সরকারের বইও রাখতেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান। পড়া বই শেষ হলে তারা নিজেরাই ফেরত দিয়ে নতুন বই নিয়ে যেতেন। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোতে ছেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরোনো বই নিয়ে আসতেন। তবে এই কাজ ছেলে হায়দার আলীকে দিয়েই বেশি করাতেন। এছাড়া পাঠাগারে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতেও পলান সরকার বই তুলে দিতেন।
ছেলে হায়দার আলী বলেন, ‘বার্ধক্যজনিত কারণে কয়েক দিন ধরে বাবা শয্যাশায়ী ছিলেন।’
বাউসা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘একজন ভালো মানুষকে আমরা হারালাম। তার মতো নিবেদিত মানুষের অভাব রয়েছে। আশা করি তার শূন্যস্থান অন্য কেউ পূরণ করবেন। তার উত্তরসূরি হয়ে আবারও আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে উঠবেন। এটা আমাদের প্রত্যাশা।’