আমাদের উৎসব, পার্বণ বা বিভিন্ন দিবসে আলপনার ব্যবহার থাকলেও এর নামে কোনও গ্রামের নামকরণ হতে পারে, তা একটু অবিশ্বাস্য বিষয়। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের ‘টিকইল’ গ্রাম কিন্তু এখন ‘আলপনা গ্রাম’ নামেই পরিচিত।
এ গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে রঙের খেলা। ঘরে ঘরে ক্যানভাস। আর এ ক্যানভাসই চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ অজপাড়াগাঁয়ের গৌরব।
জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম টিকইল। এ গ্রামের অর্ধশতাধিক বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আলপনার শোভা। বাইরের দেয়াল থেকে শুরু করে ভেতরের দেয়াল, বৈঠকখানা, বারান্দা, এমনকি রান্নাঘর- যেখানেই দেয়াল, সেখানেই রঙের ছোঁয়া।
তবে এসব আলপনা কোনও শিল্পীর আঁকা নয়। বাড়ির গৃহিণীদের হাতের তুলিতেই এমন শিল্পকর্মের সৃষ্টি। বংশ পরম্পরায় সৌন্দর্যবর্ধন ও দেবতার সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদ কামনায় এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন টিকইল গ্রামের নারীরা।
নেজামপুর ইউনিয়নের হাটবাকইল বাজার থেকে উত্তর দিকের সড়ক ধরে এগোতেই চোখে পড়ে মাটির দেয়ালঘেরা সারি সারি বাড়ি। আর এসব বাড়ির দেয়ালে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আলপনা। এঁকেবেঁকে গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে এ পাকা সড়কটি। দুই ধারের সারি সারি বাড়িগুলোর সবই প্রায় কাঁচা। ছোট-বড় সব ধরনের বাড়িই মাটির দেয়ালে গড়া। এসব বাড়ি শুধু রঙিন দেয়ালগুলোর জন্য পথচারীদের নজর কাড়ে।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে দাসু চন্দ্র বর্মনের স্ত্রী দেখন বালা বর্মনের সঙ্গে। কথা হয় ‘আলপনা’ ও আলপনা গ্রামের বিষয়ে। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। এখন বয়স ৫২ বছর। লেখাপড়া করার সুযোগ তেমন পাননি। আলপনা আঁকার কৌশল কারও কাছ থেকে শেখেননি। তবুও প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এই কাজ করে রাঙিয়ে রেখেছেন নিজের চারপাশ।
তিনি জানান, তার হাত ধরে টিকইল গ্রামের অনেক মেয়ে ও বধূ আজ আলপনা আঁকায় হাত পাকিয়েছেন। আলপনার রঙিন উপস্থাপনায় পৌষ-পার্বণে বাড়ির দেয়ালগুলো হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় ও সুন্দর।
তিনি আরও বলেন, ‘দেবতার সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদ কামনায়ও আমি আলপনা আঁকি। আমার বাড়িতে রাধাগোবিন্দ ও লক্ষ্মীর মূর্তি রয়েছে। প্রতিদিনই সকালে তাদের সেবা দিতে হয়। যার জন্য বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি।’
দেখন বালার পাশেই রণজিৎ বর্মনের বাড়ি। তার বাড়িও একইরকম পরিপাটি। তিনি পেশায় দিনমজুর ও একজন কীর্তনশিল্পী। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল জ্যৈষ্ঠের খরতাপে বর্গাচাষের বোরো ধান বস্তাবন্দি করতে ব্যস্ত তিনি। তার বাড়ির দেয়ালেও দেখা গেল বিভিন্ন আলপনা। রণজিতের স্ত্রী অনিতা বর্মন ও তাদের মেয়ে রিমা বর্মন এঁকেছেন এসব আলপনা।
অনিতা বর্মনের বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পূর্ব পাশের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে কথা হয় নয়ন মণি বর্মন, বন্দনা বর্মনসহ অনেকের সঙ্গে। তাদের সবারই বসতঘর মাটির। তারা জানান, ‘পূর্বে আলপনা আঁকতে গিরিমাটি, চক (খড়িমাটি), লালমাটি, সাদামাটি, তারপিন তেল ব্যবহার হতো। তবে সেগুলো বেশি দিন স্থায়ী হতো না। বর্তমানে শুকনো বরই চূর্ণ আঠা, গিরিমাটি, আমের পুরাতন আঁটির শাঁস চূর্ণ, চকগুঁড়া, বিভিন্ন রঙ, মানকচু ও কলাগাছের কষ দিয়ে তৈরি রঙের মিশ্রণ ৪-৫ দিন ভিজিয়ে রেখে রঙ তৈরি করা হয়। ওই রঙ দিয়ে আঁকা আলপনা অনেকদিন স্থায়ী হয়।
টিকইল গ্রামের রেখা বর্মন জানান, ‘আমরা লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব পার্বণে, বিশেষ করে নবান্নে আলপনা এঁকে থাকি। আর এই আলপনা আমরা বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধন ও দেবতাকে খুশি করতেও এঁকে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘যতদিন মানুষের সৌন্দর্য পিপাসা থাকবে, ততদিন বাঙালির হৃদয়ে আলপনা থাকবে। ‘আলপনা’ তার শাশ্বত প্রতীকী বৈশিষ্ট্যের জন্য অতীতেও যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমনি আছে এবং ভবিষ্যতেও এর আবেদন থাকবে।’