ঝুড়ি থেকে চারপাশে উপচে পড়ছে ময়লা, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। ফ্লোরজুড়ে যেখানে-সেখানে পড়ে আছে শুকনো ও ভেজা বড় বড় ঝাড়ু, হাঁটতে গিয়ে ঝাড়ুতে আটকে যায় পা। এই নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর দৃশ্যটি রাজশাহী মহানগরীর একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের। এই নগরীর প্রায় সব ক্লিনিকেরই একই দশা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনও বালাই নেই। তাদের টার্গেট একটাই—ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবার নাম করে বেশি বেশি অর্থ উপার্জন।
ক্লিনিকগুলোর এই যখন অবস্থা, তখন সেখানে অবস্থিত চিকিৎসকের চেম্বারে রোগীকে ঢুকতে হচ্ছে জুতা বাইরে খুলে রেখে খালি পায়ে। ঘিন ঘিনে নোংরা ফ্লোরে হাঁটতে একরকম বাধ্য হন তারা। রোগীর স্বজনদের দাবি—এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে চিকিৎসা নাও পেতে পারেন ভেবে অস্বস্তি নিয়েই জুতা খুলে প্রবেশ করতে হচ্ছে। তারা বলছেন, আমরা ঢাকার সমপরিমাণ ভিজিট দিয়ে সেবা নিতে এসেছি, অথচ এ ধরনের আচরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রমাণ দেখানোর পরেও ক্লিনিকের মালিকপক্ষ বলছে, তাদের ক্লিনিকে কোনও ময়লা নেই। জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশের বিষয়েও তারা কিছুই জানেন না।
নগরীর সবচেয়ে ব্যস্ত হাসপাতাল পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রয়্যাল হাসপাতাল,মেট্রোপলিটন হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে একই চিত্র নজরে আসে। যেসব ফ্লোরে রোগীরা অবস্থান করেন, সেসব ফ্লোরে দুই ঘণ্টা থেকেও কোনও ক্লিনারের উপিস্থিতি নজরে আসেনি। এসব হাসপাতালের চেম্বারে কোনও কোনও চিকিৎসক টানা রাত ২টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। কিন্তু রোগীদের জন্য বসার যথেষ্ট জায়গা নেই। শুধু তাই নয়, ফ্যান ও এসির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় রোগীদের মানবেতর পরিস্থিতির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। মেঝেতে এলোমেলো ছড়ানো ময়লা ফেলার ঝুড়িগুলো উপচে পড়ছে। মেট্রোপলিটন হাসপাতালের ভবনটি ৪০ বছরের পুরনো। ভেতরের পরিবেশ স্যাঁতসেঁতে। নেই কোনও প্রকৃত স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা। খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। অথচ রাজধানী ঢাকার সমপরিমাণ টাকা গুনতে হচ্ছে রোগীদের। ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিজেদের পরিচ্ছন্নতার ঠিক নেই, অথচ চিকিৎসকদের চেম্বারে ঢোকার সময় স্যান্ডেল খুলে ঢুকতে বাধ্য করা হচ্ছে। একসঙ্গে ছয়-সাতজন রোগীকে ভেতরে ডেকে নেওয়া হয়। তারা যখন বের হয়ে আসেন, তখন স্যান্ডেল খুঁজতে গিয়ে পা নোংরা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না, বললেও কেউ পাত্তা দেয় না।
১৮ আগস্ট বিকাল বেলা। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দেখা গেলো রোগীদের ভিড়। ঠিকমতো বসার জায়গা নেই। শিশু চিকিৎসকের কক্ষের সামনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। গরমে অতিষ্ঠ সবাই। ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গায় খোলা অবস্থায় স্তূপ হয়ে আছে ময়লা। ফ্লোরজুড়ে ধুলার আস্তরণ। এরইমধ্যে চিকিৎসকের রুমে খালি পায়ে ঢুকতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন হাসপাতাল। রোগী ও দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত টয়লেটে ঢুকে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদককেও বিপাকে পড়তে হয়। দরজার সিটকিনি ভাঙা। অনেক চেষ্টায় সিটকিনি লাগানোর পর ফের তা খোলা যাচ্ছিলো না। ভেতর থেকে খোলার চেষ্টা করলে বাইরে থেকে শব্দ শুনে রিসিপশনের এক ব্যক্তি এসে দরজা খুলে দেন। নাম প্রকাশ না করে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘নষ্ট হওয়ার পর সেটি আর ঠিক করা হয়নি।’
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ময়লার ছবি তোলার কথা জানানো হলে মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল থেকে যারা কাজ করেন, তারাই আবার ১২টার সময় ঝাড়ু দেন। তিন টাইমে ঝাড়ু দেওয়া হয়। ময়লা থাকার কথা না।’ ময়লার ভেতর কেন জুতা খুলে চিকিৎসকের রুমে ঢুকতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি হাসপাতালের কোনও নিয়ম না, কোনও চিকিৎসক পারসোনালি করে থাকতে পারেন, তবে বিষয়টি আমার জানা নেই।’
এরপর তাকে যখন পপুলারের ময়লার ছবির কথা জানানো হলো, তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি দেখবো।’ খালি পায়ে চিকিৎসকদের চেম্বারে ঢুকতে বাধ্য করার বিষয়ে তিনি জানেন না বলে উল্লেখ করেন।
ক্লিনিকগুলোর নোংরা পরিবেশের বিষয়ে প্রশ্ন করলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক গোপেন্দ্রনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি কেউ তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে, তবেই কেবল তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
আগামীকাল পড়ুন: রাজশাহীতে যত্রতত্র ফিজিওথেরাপিস্ট, ওরা কারা?