উন্মুক্তভাবে কয়লা বিক্রি, ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য-পরিবেশ

কয়লার স্তুপপাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী নৌবন্দরে উন্মুক্তভাবে কয়লা বিক্রি করা হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও কৃষি জমির।  সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই মাথায় কয়লা বহন করায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শ্রমিকরা। উম্মুক্ত কয়লা বিক্রি না করতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবসায়ীদের সতর্ক করলেও, তা মানছেন না কেউ।

এক সময় উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত নগরবাড়ী নৌবন্দর। যাত্রী পারাপার বন্ধ হলেও এ বন্দর দিয়ে সার, সিমেন্ট, কয়লা, পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য নৌপথে আমদানি করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন ব্যবসায়ীরা।

কয়লা বহন করছেন শ্রমিকরাকয়লা ব্যবসায়ীরা জানান, সোহেল ট্রেডার্স, আমান ট্রেডার্স, নওয়াপাড়া ট্রেডার্সসহ সাত জন কয়লা ব্যবসায়ী রয়েছেন নগড়বাড়ীতে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লা কার্গো জাহাজে করে নগরবাড়ী নৌবন্দরে এনে বিক্রি করেন তারা। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার ইট ভাটায় এই কয়লা ব্যবহার করা হয়।

সরেজমিনে বন্দর এলাকা ঘুরে জানা যায়, যশোরের নওয়াপাড়া গ্রুপ ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে কয়লা আমদানি করে প্রথমে নিয়ে যান চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখান থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কয়লা কিনে নগরবাড়ীতে উন্মুক্তভাবে বিক্রি করছেন।

কয়লা বহন করছেন শ্রমিকরাএলাকাবাসী জানান, লোড-আনলোডের সময় ছাড়াও স্তুপকৃত কয়লার গুঁড়া বাতাসে মিশে পার্শ্ববর্তী ফসলি জমিতে পড়ছে, এতে ওই সব জমি ফসল চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তাছাড়াও রোদ-তাপে কয়লার স্তুপে আগুন ধরতেও দেখা গেছে।

এদিকে জাহাজ থেকে কয়লা মাথায় বহন করে নামানোর জন্য প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন শত শত শ্রমিক। এসব শ্রকিক সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়া কাজ করায় কয়লার গুঁড়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ঢুকে পড়ছে তাদের ফুসফুসে। ফলে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। ক্যান্সারসহ নানা রোগের ঝুঁকির কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরাও।

কয়লা বহন করছেন শ্রমিকরাকয়লা আনলোডের কাজ করা একাধিক শ্রমিক জানান, দিন শেষে গোসলের সময় দেখা যায় নাক-মুখের ভেতর কয়লার গুঁড়া। আগের তুলনায় খাওয়া-দাওয়ায় রুচি কমে গেছে তাদের।

কয়লা শ্রমিক আব্দুর রহিম জানান, কয়লার ঝুড়ি মাথায় নিলে প্রচুর গরম লাগে। ঘামে ভিজে মাস্ক নষ্ট হয়ে যায়। নানা রকম অসুখ বিসুখ হয় জেনেও পেটের দায়ে এ পেশায় আছেন বলে তিনি জানান।

কয়লার স্তুপবেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. জাহিদ হাসান সিদ্দিকী জানান, সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই কয়লা বহনের কাজ করলে শ্বাসকষ্ট, ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। পাশাপাশি ধুলা ও কয়লা গুঁড়ার কারণে ফুসফুসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ ও দীর্ঘমেয়াদি কাশি হয়ে থাকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেটা যক্ষার রূপ ধারণ করে।

এদিকে কয়লা গুঁড়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় চাষিরাও। নগরবাড়ীর ঘাট এলাকার কৃষক ইয়াসিন আলী জানান, কয়লার গুঁড়া ফসলি জমিতে পড়ে মাটি কালো হয়ে যাচ্ছে। এসব জমিতে আর কোনও ফসলই ভালো হচ্ছে না।

কয়লা বহন করছেন শ্রমিকরাবেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মশকর আলী বলেন, ‘জমিতে কয়লার স্তর পড়লে ফসল উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। প্রাকৃতিক খাদ্য ও বাতাস থেকে মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। তবে কয়লা জাহাজ থেকে আনলোড হওয়ার পর নিদিষ্ট স্থানে আবদ্ধ করে রেখে বিক্রি করলে সবার জন্যই উপকার।’ পরিবেশ অধিদফতরের সনদ নিয়ে নিয়ম অনুয়ায়ী সংরক্ষিত এলাকায় এ ব্যবসা করা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।

পাঁচ কয়লা ব্যবসায়ী পরিবেশ অধিদফতরের সনদ নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে দাবি করলেও, তা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শ্রমিকদের সবসময় মাস্ক নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তারা।

বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আনাম সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নগরবাড়ী ঘাট এলাকার কয়লা ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে। তারা উন্মুক্তভাবে কয়লা বিক্রি না করে ঢেকে বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন। কিন্তু অনেকেই তা মানছেন না। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুতই অভিযান চালিয়ে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’