রাজশাহীতে ঘরে ঘরে করোনা রোগী, তবু উদাসীন মানুষ

রাজশাহীতে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। চোখ রাঙাচ্ছে ওমিক্রন। এ অবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। কিন্তু করোনা সংক্রমণের অন্যতম হটস্পট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। সবাই উদাসীন। এতে সংক্রমণ বাড়ছে। 

গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনায় এক নারী মারা গেছেন। সেই সঙ্গে রাজশাহীতে ৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে করোনা শনাক্তের হার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, রাজশাহীতে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। তবে করোনা রোগী বাড়লেও হাসপাতালে চাপ কম। অধিকাংশই বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন পরীক্ষা ছাড়াই। শুধুমাত্র যাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে তারাই ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘রাজশাহীতে এখন ঘরে ঘরে করোনা রোগী রয়েছেন। তারা বাড়িতে থেকে স্বাভাবিক নিয়মে জ্বর, সর্দি-কাশির চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে ভালোও হয়ে যাচ্ছেন তারা। এজন্য হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ কম। তবে যাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে তারাই শুধু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এদের মধ্যে টিকা না নেওয়ার সংখ্যা বেশি। পরীক্ষা করলে দেখা যায়, অধিকাংশই পজিটিভ। বাড়িতে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা পরীক্ষা করান না। এদের সংখ্যা বেশি। এজন্য আমরা বলছি, সবার ঘরে রয়েছেন করোনা রোগী।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (২৬ জানুয়ারি) সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল ৯টার মধ্যে রামেক হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত এক রোগী মারা গেছেন। তিনি রাজশাহী জেলার বাসিন্দা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। সেখানেই মৃত্যু হয়।’

এদিকে, ১০৪ শয্যার রামেকের করোনা ইউনিটে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রোগী ভর্তি আছেন ৪৯ জন। একদিন আগেও এই সংখ্যা ছিল ৪৯। বর্তমানে রাজশাহীর ২৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচ, নওগাঁর তিন, নাটোরের চার, পাবনার তিন, কুষ্টিয়ার তিন, সিরাজগঞ্জের এক, ঝিনাইদহের এক এবং মেহেরপুরের একজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালে করোনা নিয়ে ভর্তি রয়েছেন ৩৫ জন। উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রয়েছেন ১৪ জন। করোনামুক্ত দুজন ভর্তি রয়েছেন। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ১০ জন। এদিন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন আট জন।

এরই মধ্যে রাজশাহীতে ৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে করোনা শনাক্তের হার। বুধবার রাতে রাজশাহীর দুটি পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় ৬০ দশমিক ৩৯ শতাংশ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়।

ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাজশাহীর দুটি পিসিআর ল্যাবে ৪৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২৮২ নমুনায় মিলেছে করোনাভাইরাস। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৬০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবে ৯০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত হয় ৪৫ জনের। একই সময়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ল্যাবে ৩৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা ধরা পড়ে ২৩৭ জনের। এর আগের দিন মঙ্গলবার রাজশাহীর দুটি পিসিআর ল্যাবে ৫৮৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৩৪৪ নমুনায় মিলেছে করোনাভাইরাস। নমুনা পরীক্ষার হিসাবে শনাক্তের হার ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। সোমবার রাজশাহীর দুটি ল্যাবে ৫৪৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩০৪ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। রবিবার রাজশাহী জেলায় শনাক্তের হার ছিল ৬০ দশমিক ৪৯।

নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় অবস্থিত হাসপাতাল,  ক্লিনিক, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে, ক্লিনিকগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশের কাছে মাস্ক থাকলেও সঠিক নিয়মে পরছেন না। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রিসিপশনে কর্মরতদের নাকের নিচে মাস্ক ঝুলিয়ে রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। আর প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। রোগীরা গাদাগাদি করে বসে থেকে চিকিৎসকের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।

নগরীর পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সবচেয়ে বেশি রোগী দেখা গেছে। রোগীদের প্রায় ৩০ শতাংশের মুখে মাস্ক ছিল না। সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না। একই চিত্র দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, দি অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টার, মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সিডিএম হাসপাতাল, লেজার হাসপাতাল, জমজম ইসলামি হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও।

দি অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টারের এমডি ইমাম হোসেন জানান, তারা বাধ্যতামূলক মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিতে রোগীদের উদ্বুদ্ধ করছেন। যেসব রোগী বা তাদের স্বজন মাস্ক ছাড়াই আসছেন তাদেরকে মাস্ক সরবরাহ করছেন তারা। এছাড়া সরকারি বিধিনিষেধ প্রতিষ্ঠানের সামনেই টানানো আছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলেও জানান ইমাম হোসেন। 

ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী কর্মকর্তা মো. শাহিন জানান, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে জায়গা কম থাকার কারণে কিছু কিছু সময় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হচ্ছে না। তবে হাসপাতালে প্রবেশে হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ মাস্ক ব্যবহারে অনুরোধ জানানো হচ্ছে এবং সিংহভাগ মানুষ তা মানছেন।

নগরীর প্রায় সব ফার্মেসির সামনে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন’ এমন সতর্কতা বার্তা ঝোলানো থাকলেও নিজেরাই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। ফার্মেসিতে কর্মরতদের অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। মাস্ক না পরেই রোগী ও তাদের স্বজনদের মেডিসিন সরবরাহ করছেন তারা। অনেক ক্রেতাও মাস্ক ব্যবহার করছেন না। এতে নিজে সংক্রমিত হওয়ার পাশাপাশি অন্যদের সংক্রমিত করার ঝুঁকি বাড়ছে। অথচ নিজেরা মাস্ক ব্যবহার না করলেও অন্যদের মাস্ক ব্যবহারে সতর্ক করা হচ্ছে বলে জানান তারা।

নগরীর পলাশ ফার্মেসির মালিক ফজলুর রহমান জানান, তার ফার্মেসিতে চার জন কর্মরত আছেন। সবাই করোনার টিকা নিয়েছেন। সবাই বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করছেন। তবে কখনও কখনও মাস্ক খুলে রাখছেন।

নগরীর মহারাজ ফার্মেসির ম্যানেজার সোহেল রানা বলেন, মাস্ক ব্যবহার করছি। তবে সবসময় মাস্ক পরে থাকা যায় না। তাই যখন ক্রেতা সমাগম থাকে না সেসময় মাস্ক নাকের নিচে অথবা খুলে রাখি। 

এদিকে, শুধু হাসপাতাল নয়; সংক্রমণের হটস্পট লক্ষ্মীপুর এলাকায় রোগীর সেবা সংশ্লিষ্ট অ্যাম্বুলেন্স সেবা, খাবারের দোকান, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। মাস্ক থাকলেও তা নাকের নিচে অথবা থুতনিতে ঝুলিয়ে রেখেছেন তারা।

এ বিষয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাবিহা সুলতানা জানান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে রাজশাহী সিভিল সার্জনের প্রতিনিধিরা কাজ করছেন। ফার্মেসিগুলোতে ভোক্তার অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও অভিযান চলছে। অভিযান পরিচালনা করার সময় আমরা যখনই যাই, ফার্মেসিতে বিক্রেতাদের মুখে মাস্ক দেখতে পাই। আমরা চলে আসার পর অনেকেই মাস্ক পরছেন না। আসলে সবসময় ওভাবে মনিটরিং করাও সম্ভব না। এ বিষয়ে নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। তবেই সংক্রমণ কমবে।