প্রাণ বাঁচানো ঢোপকলের ঠাঁই হচ্ছে জাদুঘরে

১৯৩০-এর দশকে রাজশাহীতে কলেরা প্রাদুর্ভাবকে রুখে দিতে প্রয়োজন ছিল সুপেয় পানি। আর সুপেয় পানির নিশ্চয়তা নিয়ে যুগান্তকারী উদ্যোগে নির্মাণ হয় ‘ঢোপকল’। সুপেয় পানির সরবরাহকারী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় আজও উজ্জ্বল এটি। এখন অবশ্য ঢোপকলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তবে ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন সড়কে প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন স্থাপত্য হিসেবে ঠাঁই মিলেছে জাদুঘরেও।

জানা গেছে, রাজশাহী নগরীতে এখন মাত্র ২২টি ঢোপকল চালু আছে। তবে ঢোপকলের যে বিশেষত্ব তা এখন আর কার্যত নেই। একটি ঢোপকল প্রায় ১২ ফুট উঁচু এবং ৪ ফুট ব্যাসের। ঢোপকল তৈরিতে মূল উপকরণ হিসেবে সিমেন্ট ও খোয়া (ইটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডিত অংশ) ব্যবহার করা হয়েছে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো ডিজাইন। এই নকশা করা হয়েছে টিনের সাহায্যে। চারিদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই দেওয়া হয়েছে। প্রায় আড়াই থেকে তিন ইঞ্চির এই ঢালাই খুবই শক্ত। তবে এই অবয়বের বাইরে ঢোপকলের প্রধান বিশেষত্ব ছিল ‌ফিল্টারিং সিস্টেম, যা কয়েক যুগ আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।

ছোট নগরী রাজশাহীতে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহে ফিল্টারিং সিস্টেমসহ প্রায় শতাধিক ঢোপকল ছিল।  মহারানি হেমন্ত কুমারী দেবী পানি শোধন কেন্দ্র থেকে পানির আয়রন ও ক্ষারতা দূর করা হতো। তারপর সেটা সরবরাহ করা হতো ঢোপকলে। মূলত দটি ধাপে পানি শোধন করা হতো। কেন্দ্রীয় সঞ্চালন লাইন থেকে শোধন হওয়ার পর তা আবারও ঢোপকলে ফিল্টার হতো। ঢোপকলে পানি শোধনে পাথরকুঁচির ফিল্টার ব্যবহার করা হতো। বালি ও পাথরের স্তর থাকায় পরিশোধিত পানি গরমের সময় ঠান্ডা ও শীতের সময় উষ্ণ থাকতো। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়।

রাজশাহী নগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহের কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে ঢোপকল

জানা গেছে, রায় ডি এন দাশগুপ্ত ১৯৩৪ সালে রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। তখন ডায়রিয়া ও কলেরায় রাজশাহীতে অনেকের মৃত্যু হচ্ছিল। এই সংকট সমাধানে চেয়ারম্যান শহরে পাইপলাইনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পরিকল্পনা নেন। এতে সহায়তা করে ‘রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি জনকল্যাণমূলক সংগঠন। শহরের ধনী ব্যক্তিদের সহায়তার আহ্বান জানানো হয় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার জন্য। এমন আহ্বানে সাড়া দেন পুঠিয়ার মহারানি হেমন্ত কুমারী। তিনি একাই দান করেন ৬৫ হাজার টাকা। স্থাপন করা হয় একটি পানি শোধনাগার। এরপর তখনকার ছোট্ট শহরটির মোড়ে মোড়ে পানি পৌঁছে দিতে পশ্চিমে কোর্ট, পূর্বে রামচন্দ্রপুর, পদ্মার পাড় ও গৌরহাঙ্গা পর্যন্ত এলাকায় স্থাপন করা হয় ৯৯টি ঢোপকল।

রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা বলেন, ‘ঐতিহ্যের ধারক ঢোপকলগুলোকে ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা উচিত। প্রয়োজনে সেগুলোকে ঠিক রেখে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী শাখার সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন বলেন, ‘ঢোপকলগুলো ভেঙে ফেলা সাংস্কৃতিক অপরাধ। বিশ্বের অন্যান্য শহরে এ ধরনের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য অর্থ খরচ করা হয়। অর্থ খরচ করে এগুলো সংরক্ষণ করা হয়। আর আমরা এগুলো ভেঙে ফেলছি!’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা শাখার সভাপতি ও রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘রাজশাহী নগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহের কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে ঢোপকল। মহারানী হেমন্ত কুমারীর দান এবং প্রশাসনিক উদ্যোগ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তবে সেই সময় নগরবাসীকে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহে ঢোপকল স্থাপন প্রকল্প যে ভূমিকা রেখেছে, তা রাজশাহী ওয়াসা রক্ষা করতে পারেনি। বিশুদ্ধ পানির সরবরাহের প্রশ্নে ওয়াসা পিছিয়ে।’

ঢোপকলের কার্যকারিতা এখন বিলুপ্তির পথে

তিনি আরও বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢোপকলগুলো বিলুপ্তির পথে। নগর উন্নয়ন কাজে বেশকিছু ঢোপকল ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রের আন্তরিকতায় ও সুশীল সামাজের দাবির মুখে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঢোপকল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে ঢোপকল।’

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ সরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য অনেক ঢোপকল ভেঙে ফেলতে হয়েছে। এখন সব বাড়িতেই পানি সরবরাহ থাকায় এগুলোর ব্যবহার নেই। ঢোপকল আর ব্যবহারের জন্য নগরীতে রাখা হবে না। এর ভেতরে শ্যাওলা জমে যায়। পানি পড়ে ফুটপাত নষ্ট হয়। তাই একে এখন শুধু প্রদর্শনীর জন্য রাখা হবে। বরেন্দ্র জাদুঘরে দুটি, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে ডিআইজি অফিস পর্যন্ত তিনটি এবং কাজলায় মাহবুর রহমানের আর্কাইভে একটি ঢোপকল প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। বর্তমানে রাজশাহীতে সুপেয় পানি সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে ওয়াসা। চালু থাকা ঢোপকলগুলো তারা রিজার্ভার হিসেবেই ব্যবহার করছেন।’

রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. পারভেজ মাসুদ জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। ঢোপকলের কার্যকারিতাও এখন বিলুপ্তির পথে। তবে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে নগরীর দর্শনীয় স্থান, গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও জাদুঘরে ঢোপকলগুলোকে স্থানান্তর করা হচ্ছে।