দখল হয়ে যাচ্ছে নাটোরের পানিশূন্য নদ-নদী

দেশের বৃহৎ চলনবিল অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র নাটোরে রয়েছে ১১টি নদ-নদী ও ৩৫টি খাল। কৃষি প্রধান এই অঞ্চলটিতে ফসলের সহায়ক ছিল ওই নদ-নদী আর খালগুলো। কেননা, গ্রীষ্মকালে নদ-নদী আর খালের পানি ব্যবহার করে কৃষকরা যেমন ফসল ফলাতেন, তেমনি বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জমা হতো ওই সব জলাধারে। এতে পানির কোনও সমস্যা হতো না বাড়ির টিউবওয়েল গুলোতে। তবে গত কয়েক বছর ধরে ওই সব নদ-নদী আর খাল দখল হতে শুরু করেছে। আবার বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়ভাবে ভরাট হওয়ায় বিঘ্নিত হয় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ। এতে একদিকে যেমন নদ-নদী খাল আকৃতিতে সংকুচিত হতে থাকে, অপরদিকে বন্ধ হতে শুরু করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ। এর প্রভাবে কৃষি চাষাবাদ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ির নলকূপগুলোতে গ্রীষ্ককালে দেখা দিচ্ছে পানির সংকট।

সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের গোষপাড়া এলাকার বাসিন্দা রাজা জানান, তার বাড়ির পাশ দিয়ে রয়েছে একটি শাখা নদী আর একটি খাল। কিন্তু ওই নদী আর খাল গত কয়েক বছরে অনেকটাই দখল হয়ে গেছে। এখন স্থানীয় কৃষকরা চাষাবাদে পড়ছেন সমস্যায়। আবার কয়েক বছর থেকে গ্রীষ্মকালে পাওয়া যায় না পানি।

নাটোর শহরের কানাইখালী মহল্লার বাসিন্দা রানা জানান, তার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গদাই নদী। এক সময় ওই নদী প্রবাহমান থাকলেও গত কয়েক বছরে অনেকটাই দখল হয়ে গেছে। এতে ওই নদীর পানিতে জন্ম নিচ্ছে মশাসহ নানা প্রাণি, যা নষ্ট করছে পরিবেশ। আবার বদ্ধ পানি পঁচে তার দুর্গন্ধে বসবাস করাই মুশকিল।

নলডাঙ্গা উপজেলার বাসুদেবপুর এলাকার বাসিন্দা জরিপ জানান, নলডাঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে বারনই নদী। গত কয়েক বছর থেকে শুরু হয়েছে ওই নদীর পাড় দখলের মহোৎসব। এতে বিগ্ন হচ্চে পানি প্রবাহ। হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র।

গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় এলাকার বাসিন্দা সালাম জানান, গুরুদাসপুর উপজেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদ-নদী এখন সৌন্দর্য, জৌলুশ ও স্বকীয়তা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। দখল, দূষণ ও ভরাটে এ উপজেলার প্রধান নদী গুমানী, আত্রাইসহ তুলসীগঙ্গা, মির্জামামুদ ও খলিসাডাঙ্গা সংকুচিত হয়ে পড়ায় অস্তিত্ব সংকটে এখন মৃতপ্রায়। ফলে কৃষি জমির সেচ কাজ ব্যাহতসহ দেশীয় মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। বেকার হচ্ছে নদীতে জীবিকা নির্বাহ করে খাওয়া মানুষগুলো। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।

স্থানীয় পরিবেশকর্মী তানিম জানান, বর্ষা শেষে চলনবিলের নদী-নালা ও খাল-বিলে পানি থাকে না। তাই বন্ধ হয়ে গেছে নৌ চলাচল। জেলেদের জালে মাছ ধরছে না। ধান চাষ হচ্ছে এসব মরা নদীতে। অথচ এক সময় এসব নদীতেই বছর জুড়ে পানি থাকতো। চলাচল করতো ছোট বড় নৌকা। এসব নদী আর নৌকাকে ঘিরেই গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড়, নাজিরপুর, খুবজীপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম, আহম্মেদপুর, তাড়াশ, ধামাইচ, নাদোসৈয়দপুর, চাটমোহর, ছাইকোলা, অষ্টমনিষা, মির্জাপুর, ভাঙ্গুড়ায় গড়ে উঠেছিল বড় নৌ-বন্দর। চলতো রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য। কালের বিবর্তনে সেসব এখন শুধুই ইতিহাস।

স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানান, নদীর পানিতে সেচ সুবিধাসহ ফসলের উৎপাদন খরচ কম হতো। এখন আর নদীর পানি দিয়ে সেচ হয় না। আবার ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়লেও বিক্রিতে মূল্য পাওয়া যায় না। এক সময় নৌকায় করে শত শত মণ ধান, পাট, গম সরিষাসহ চলনবিলের সকল কৃষিজাত পণ্য ঢাকা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করতেন ব্যবসায়ীরা। মোকাম থেকেই নানা পণ্য গুরুদাসপুরে এনে পাইকারি দামে বিক্রি করতেন। নদীপথে কম খরচে সহজলভ্য পরিবহন সুবিধা ভোগ করলেও বর্তমানে পানি না থাকায় আগের মতো ব্যবসা করতে পারছেন না তারা।

চলনবিল ও নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি মজিবর রহমান মজনু জানান, গুরুদাসপুর পৌর সদরের চাঁচকৈড় মধ্যমপাড়া থেকে উপজেলার চলনালী-কান্দিপাড়া, কান্টাগাড়ী বিল হয়ে পাটপাড়া, সোনাবাজু, চাকলের বিল এবং পশ্চিমের চাপিলা হয়ে নন্দকুঁজা নদীতে মিলিত হয়েছে মির্জা-মামুদ নদ। এই নদীর সংযোগ নালা বয়ে গেছে দক্ষিণের সিধুলী হয়ে চরকাদহ, ধারাবারিষা, চামটা বিলে। দখল ও ভরাটে এই নদের স্মৃতিচিহ্নই মুছে গেছে। নদীগুলো রক্ষায় সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপেরও দাবি জানান তিনি।

এ ব্যাপারে নাটোর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘২ হাজার ১৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে নাটোরের প্রধান নদী নারদ, বড়াল ও মুসাখাঁ মিলে ১৫৪ কিলোমিটার শাখা নদী পুনঃখননের জন্য পৃথক একটি প্রকল্প উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলেই ছোট-বড় নদীনালা খনন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।