র‌্যাব হেফাজতে মারা যাওয়া জেসমিনের মাথায় ও হাতে আঘাতের চিহ্ন

র‌্যাব হেফাজতে অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যাওয়া নওগাঁর সুলতানা জেসমিনের (৪২) হাতে ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পাশাপাশি এই দুই আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনটিতে হাতের কনুইয়ের উপরিভাগে আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ করলেও ময়নাতদন্তের সময় চিকিৎসকরা দেখেছেন, হাতের মাংসে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল।

নওগাঁ সদরের চন্ডীপুর ইউনিয়নের ভূমি অফিসের সহকারী জেসমিনের মৃত্যুর পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে গিয়ে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার জেসমিন আক্তার। তিনি জানান, মাথা ছাড়াও জেসমিনের ডান হাতের কনুইয়ের কাছে তিনি আঘাত দেখেছেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে এসব আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

রামেক হাসপাতালের মর্গে তিন জন চিকিৎসকের একটি বোর্ড ময়নাতদন্ত করেন। এই দলের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন। তিনিও নিশ্চিত করেন, লাশের ডান হাতের বাহুর নিচে ও কনুইয়ের কাছে একটা কালো জখম ছিল। আঘাতের এই চিহ্ন নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে।

জেসমিনের স্বজনদেরও দাবি, আটকের পর জেসমিনকে নির্যাতন করেছিল র‍্যাব। এর ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বরাবরই নির্যাতন করা হয়নি বলে দাবি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু: কোনও অভিযোগ নেই পরিবারের, করবে না মামলাও

গত বুধবার (২২ মার্চ) সকাল ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার পথে নওগাঁ থেকেই তাকে আটক করে র‌্যাব-৫ এর রাজশাহীর একটি দল। জেসমিনের মামা নাজমুল হক মন্টু জানান, তার ভাগনিকে আটক করা হয়েছিল নওগাঁর নওজোয়ান মোড় থেকে।

র‌্যাব দাবি করছে, আটকের পরই অসুস্থ হয়ে পড়লে জেসমিনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে জেসমিনের পরিবারের দাবি, সকালে আটক করা হলেও নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেসমিন কোথায় ছিলেন তাও জানা যায়নি। অথচ নওজোয়ান মোড় থেকে হাসপাতালের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার। রাস্তায় যানজটও ছিল না। গাড়িতে যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট। বাকি সময় কোথায় ছিল? সময় মিলছে না বলেই তাদের সন্দেহ তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।

এদিকে, নওগাঁ হাসপাতাল থেকে জেসমিনকে রামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল একই দিন (বুধবার) রাত সাড়ে ৯টায়। শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকালে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মারা যান। শনিবার সকালে রামেক হাসপাতালেরে মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এরপর নিথর জেসমিনকে স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়। পরে স্বজনরা দাফন সম্পন্ন করেন।

এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম শামীম আহমদ জানান, জেসমিনের মাথার ডান পাশে তারা একটি আঘাতের চিহ্ন দেখেছিলেন। সিটি স্ক্যানে দেখা গেছে, তার মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। এর বাইরে তারা অন্য কোথাও আঘাত দেখেননি।

এ বিষয়ে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও রামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. কফিল উদ্দিন জানান, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ কেন হয়েছে তা জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সবগুলো রিপোর্ট এলে দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন চিকিৎসক বসে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন। তখন মতামতসহ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। প্রতিবেদনের তৈরি করতে আরও চার-পাঁচ দিন সময় লাগবে।

এদিকে, মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জেসমিনকে আটকের পর অসুস্থ হলে হাসপাতালে পাঠিয়ে আমরা যুগ্ম সচিব এনামুল হককে বলি আপনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে থানায় যান। তিনি নিজে বাদী হয়ে তখন মামলা করেন। এখানে যেহেতু একটি অভিযোগ এসেছে, আমাদের হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। সোমবার একটি তদন্ত কমিটি করেছি। এখানে আমাদের সদস্যদের গাফিলতি রয়েছে কি না বা তার সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে কি না আমরা সেটা তদন্ত করছি।’

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গাফিলতি পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আদালতও আমাদের কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন। সেগুলো আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতে জানাবো।’

এদিকে, এই বিষয়ে জানতে মামলার বাদী রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে কর্মরত যুগ্ম সচিব এনামুল হকের মোবাইল নম্বরে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।