লেকে ভাসছিল ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থীর লাশ, স্বজনদের দাবি পরিকল্পিত হত্যা

বগুড়ার শাজাহানপুরে নিখোঁজের তিন দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হাসিন রাইহান সৌমিকের (৩০) ভাসমান লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রবিবার (২৯ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাঝিড়া বি-ব্লক এলাকার স্টেশন বোট ক্লাবের লেক থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।

লাশ উদ্ধারের পর বোট ক্লাবের সিসিটিভির ফুটেজ দেখে পুলিশ বলছে, লেকে নেমে আত্মহত্যা করেছেন সৌমিক। কেন আত্মহত্যা করেছেন, সে ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশ।

তবে পুলিশের দাবি প্রত্যাখ্যান করে সৌমিকের বাবা, চাচা ও পরিবারের সদস্যরা বলছেন, পূর্ববিরোধের জের ধরে সৌমিককে শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

সৌমিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার কোহিনূর গার্ডেনের বাসিন্দা তৌফিকুর রহমানের ছেলে। তাদের গ্রামের বাড়ি সোনাতলা উপজেলার বোচারপুকুর গ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে শহরের কোহিনূর গার্ডেনে বসবাস করছে তার পরিবার। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

স্বজনরা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে হাঁটার জন্য শহরের বাসা থেকে বের হন সৌমিক। এরপর থেকে নিখোঁজ ও মোবাইল নম্বর বন্ধ ছিল। পরদিন বাবা তৌফিকুর রহমান বগুড়া সদর থানায় নিখোঁজের জিডি করেন। পাশাপাশি পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা খোঁজাখুঁজি করছিলেন।

শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সৌমিক নিখোঁজের ঘটনায় গত শুক্রবার তার বাবা সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তার সন্ধান চেয়ে থানায় বার্তা পাঠানো হয়েছিল। রবিবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে মাঝিড়া ক্যান্টনমেন্টের বি-ব্লক এলাকার স্টেশন বোট ক্লাবের লেকে একটি লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খবর পেয়ে স্বজনরা লাশ দেখে পরিচয় নিশ্চিত করেন। তবে সুরতহাল প্রতিবেদনে শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। এখন পর্যন্ত হত্যার কোনও আলামতও মেলেনি।’

শাজাহানপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদ করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সৌমিকের প্যান্টের পকেটে পলিথিনে মোড়ানো মানিব্যাগ ও ব্লুটুথ পাওয়া গেছে। তবে সুরতহাল প্রতিবেদনে শরীরে আঘাতের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বোট ক্লাবের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজে দেখে গেছে, শনিবার রাতে সৌমিক নিজেই লেকে নামেন। এরপর মৃত্যু হয়। লাশ বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা।’

সৌমিকের লাশ উদ্ধারের পর বাবার কান্না

সদর থানার ওসি হাসান বাসির বলেন, ‘সৌমিকের নিখোঁজের ঘটনায় তার বাবা থানায় জিডি করলে সন্ধান চেয়ে থানায় থানায় বার্তা পাঠানো হয়। তিন দিনের মাথায় লাশ উদ্ধার হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।’

লেক থেকে লাশ উদ্ধারের সময় সেখানে উপস্থিত থাকা শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) তাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লেকে যে পরিমাণ পানি ছিল, তাতে ওই যুবকের ডুবে মৃত্যু হওয়া সম্ভব নয়। লাশ পানিতে উপুড় হয়ে ভাসছিল। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল।’

বাবা তৌফিকুর রহমান হেলাল ও চাচা সোনাতলা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান হাবিব রতন জানান, সৌমিক বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার কোনও হতাশা ছিল না। এ ছাড়া বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে আত্মহত্যার কোনও কারণ নেই। 

তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাটের এসির পানি পড়া নিয়ে ঈদের আগে নিচতলার এক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে সৌমিকের ঝগড়া হয়েছিল। আমার ধারণা, ওই ঘটনার জেরে সৌমিককে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা সৌমিকের নামে ঢাকায় যাওয়ার বাসের টিকিট সংগ্রহ করেছিল বলে জেনেছি। এ ছাড়া তার মোবাইল ফোনে বরিশাল ও ঢাকার মতিঝিল থেকে আসা ফোনের রেকর্ড আছে। ওই চক্র এ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে নিতে ঢাকায় যাওয়ার বাসের টিকিট সংগ্রহে দেখায়। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করবো।’

হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে সৌমিকের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ি সোনাতলার বোচারপুকুর গ্রামে নেওয়া হয়েছে। এমন মৃত্যুতে শুধু তার পরিবারে নয়, পুরো গ্রাম ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে শোকের ছায়া নেমেছে।