‘নদী আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সেখানে আমি যা খুশি তাই করবো’

PANCHAGARH-RIVER-PIC_03

‘আমার ৫০০ বিঘা জমি চিলকা নদীর গর্ভে। সেই জমির ওপর দিয়েই নদীটি প্রবাহিত হচ্ছে।  তাই নদীটি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আমার সম্পত্তিতে আমি যা ইচ্ছা তাই করবো, তাতে কারও ক্ষতি হওয়ার কিছু নেই।’ নদীর গতি প্রবাহ রুদ্ধ করে পাথর উত্তোলনকারী আমিনুর রহমান এভাবেই দিলেন তার কাজের ব্যাখ্যা।

শুধু আমিনুর নয়, তার মতো অনেক পাথর ব্যবসায়ী পঞ্চগড় জেলার বেশ কয়েকটি নদীর প্রবাহ বন্ধ করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছে। তাদের এ কাজের জন্য মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে স্থানীয় নদীগুলোর। ফলে নদীর ওপর নির্ভরশীল কৃষকরা সমস্যায় পড়ছেন। আবার নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় উজানে থাকা অঞ্চলগুলো খরা মৌসুমেও প্লাবিত হচ্ছে। অসাধু পাথর ব্যবসায়ীরা ভূমি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রশাসনের লোকজনদের ‘ম্যানেজ’ করে এভাবে পাথর উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয়দের অভিযোগ ও সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, জেলার পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া ও বোদা উপজেলার চিলকা, ভেরসা, চাওয়াই, করতোয়া, ডাহুকসহ বেশ কয়েকটি নদীর গতি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে নদীর বুকে বালি ফেলে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।

সদর উপজেলার চিলকা নদীর গতি প্রবাহকে আটকে দিয়ে মাঝিপাড়া এলাকায় পাথর উত্তোলন করছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। পাথর উত্তোলনের জন্য নদীর মধ্যে বালির বাঁধ দেওয়া হয়েছে।  এ কারণে ভবিষ্যতে এ নদীটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

PANCHAGARH-RIVER-PIC_02

স্থানীয়রা জানায়, মাঝিপাড়া এলাকার পাথর ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান ও আমিনার রহমান চিলকা নদীর গতি প্রবাহকে আটকে দিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন। সদর উপজেলার খাসমহল এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে বিশ কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়া চিলকা নদী তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকার চাওয়াই নদীতে এসে মিলেছে। চিলকা ও চাওয়াই নদীর মিলনস্থলে চাওয়াই নদী ভরাট করে পাথর উত্তোলন করছে ওই এলাকার রুবেল ইসলাম, ফেরদৌস আলী এবং ফারুক হোসেন নামের কয়েকজন পাথর ব্যবসায়ী। এভাবে বালি ভরাট চলতে থাকলে অল্পদিনেই চাওয়াই নদীও মরে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওই এলাকার হাজার হাজার কৃষক।

তেঁতুলিয়ার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের কাটাপাড়া এলাকায় ভেরসা নদীর গতি প্রবাহ বন্ধ করে পাথর উত্তোলন করছেন ওই এলাকার পাথর ব্যবসায়ী মনসুর আলী, ইসমাইল হোসেন, এনতাজুল হক, বোরহানউদ্দিন, নজরুল ইসলাম, আসিরউদ্দিন। তারা নদী ও নদীর আশপাশের সরকারি মালিকানাভুক্ত জমি থেকেও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছেন। ভেরসা নদীর গতি প্রবাহকে আটকে দেওয়ার কারণে উজানে হাজার হাজার একর জমি খরা মৌসুমে প্লাবিত হয়ে পড়েছে।

এলাকাবাসী পাথর উত্তোলন বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে গণস্বাক্ষর সম্বলিত লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না স্থানীয় প্রশাসন।

PANCHAGARH-RIVER-PIC_01

উপজেলার কাটাপাড়া গ্রামের আলিম উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, মোস্তফা কামাল, রবিউল ইসলামসহ স্থানীয়রা জানান, পাথর উত্তোলনের বালি দিয়ে ভেরসা নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে। নদীর বুক চিরে পাথর উত্তোলন করছে তারা। নদী মরে গেলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ এলাকার হাজার হাজার কৃষক।

জেলার বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নেও অবৈধভাবে করতোয়া নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর ও বালু উত্তোলন করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হওয়ায় কেউ ভয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।

স্থানীয় ভূমি অফিস, উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে নদী থেকে বালু পাথর উত্তোলনের মহোৎসব।

পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বাবু জানান, অবৈধভাবে নদী থেকে পাথর উত্তোলন করায় নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে একদিকে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

PANCHAGARH-RIVER-PIC_04

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সানিউল ফেরদৌস জানান, অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত চলছে। খুব শিগগিরই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পঞ্চগড়ের মাটিতে প্রচুর নুড়ি পাথর রয়েছে। তাই মাটি খনন করে অনেকেই পাথর উত্তোলন করেন। কিন্তু নদী দখল বা  ভরাট করে পাথর উত্তোলন করা বেআইনি। বিষয়টি আমি অবগত নই। যারা বেআইনিভাবে পাথর উত্তোলন করবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাণিজ্য!

তীব্র শীতেও খোলা আকাশের নিচে সাঁওতালরা

/এসটি/