জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে কিছুই জানতো না রাজীব গান্ধীর পরিবার





গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনাকারী জঙ্গি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই জানতো না তার পরিবার। এলাকাবাসীরও জাহাঙ্গীরের বিষয়ে এমন কোনও ধারণা ছিল না। জাহাঙ্গীরের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ১০ বছর আগে বিয়ে করার পর গ্রাম ছেড়ে চলে যায় সে। এরপর বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে।GAIBANDHA-JONGHI RAJIB-TR-P-1
জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম রাঘবপুর ভুতমারাঘাট (চকদাতেয়া) গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের স্কুলশিক্ষক মৃত ওসমান মণ্ডলের ছেলে। তার বাবা স্থানীয় মিয়ার বাজার হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এছাড়া শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি স্থানীয় মুসল্লিদের নিয়ে নামাজে ইমামতি করতেন।
রবিবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে জাহাঙ্গীরের নিজ এলাকায় গিয়ে এসব তথ্য জানা যায়। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি পাকা ঘর আর ছোট দুটি টিনের ঘর। এরমধ্যে পাকা ঘরটি তালাবদ্ধ। টিনের ঘরে শুয়ে কান্নাকাটি করছেন জাহাঙ্গীরের মা রাহেলা বেগম ও তার পাশেই রয়েছেন জাহাঙ্গীরের ৯ বছরের ছেলে ওয়াছিদ। তখন বাড়িতে জাহাঙ্গীরের ছোট বোন রেজওয়ানাও ছিলেন।
জাহাঙ্গীরের ছোট বোন রেজওয়ানা বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘১০ বছর আগে জাহাঙ্গীর চাকরির জন্য ঢাকা যায়। সেখানে সে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। এর দুই-তিন মাস পর জাহাঙ্গীর বাড়ি ফিরে গোবিন্দগঞ্জের শংকরগঞ্জঘাটে মাহামুদাকে বিয়ে করে। বিয়ের ৮-৯ মাস স্ত্রীকে নিয়ে জাহাঙ্গীর নিজ বাড়িতে ছিল। দুই ভাই আবু তাহের ও আবদুল আলিম আগে থেকে গোবিন্দগঞ্জ শহরে কাঠ ও গ্যাসের ব্যবসা করতো। পরে জাহাঙ্গীরও ব্যবসার জন্য নিজ বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে তার শ্বশুর বাড়িতে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাহাঙ্গীর শ্বশুর বাড়িতে থাকার পর ব্যবসার জন্য মায়ের কাছে টাকা চায়। পরে মা-বাবার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে জাহাঙ্গীরসহ অপর দুই ভাইকে নগদ টাকা ও গোবিন্দগঞ্জের মালঞ্চ গ্রামে জায়গা কিনে দেওয়া হয়। সেখানে জাহাঙ্গীরের নামে চারশতক জমিতে দুটি ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস শুরু করে জাহাঙ্গীর। এরমধ্যে জাহাঙ্গীরের দুই ছেলে জন্ম হয়। বড় ছেলে ওয়াছিদ (৯) ও ছোট ছেলে আবদুল্লা (৫)। গত চার বছর আগে ছেলে ওয়াছিদকে জাহাঙ্গীর ও তার মা মাহামুদা সাঘাটার একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়। কিন্তু তারপর ছেলের আর কোনও খোঁজ নেয়নি তারা। ’GAIBANDHA-JONGHI RAJIB-TR-P-4 (1)
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা আলতাব হোসেন জানান, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলে জাহাঙ্গীরের নাম উঠে আসে। এনিয়ে কয়েকবার পুলিশ-র‌্যাব তার মালঞ্চ গ্রামের বাড়ি ও নিজ বাড়িতে অভিযান চালায়। সেসময় পুলিশ-র‌্যাব মাদ্রাসা থেকে তার ছেলে ওয়াছিদসহ তার দাদী রাহেলা বেগমকে আটক করে জিঞ্জাসাবাদ করে। এরপর থেকে ওয়াছিদকে আর মাদ্রসায় নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে ওয়াছিদ তার দাদীর কাছে থাকে।
জাহাঙ্গীরের মা রাহেলা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে বাড়ি ছেড়ে গত ১০ বছর ধরে গোবিন্দগঞ্জের মালঞ্চ গ্রামে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতো। বাড়িতে সে কখনও আসতো না। এমনকি আমারও কোনও খোঁজ নিতো না। তিন বছর আগে জাহাঙ্গীর তার ৯ বছরের ছেলে ওয়াছিদকে সাঘাটার একটি স্থানীয় হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে। এরপর সে আর ওয়াছিদের খোঁজ নেয়নি। বর্তমানে ওয়াছিদ স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। নাতি ওয়াছিদকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে না কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাহাঙ্গীর ছোট থেকে নম্র, ভদ্র ছিল। কখনো কোনও ঝগড়া বিবাদে জড়াতো না। কিন্তু কীভাবে সে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়লো তা বুঝতেই পারছি না।’
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম জাহাঙ্গীর সম্পর্কে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর বোনারপাড়া আলিম মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। এরপর থেকে সে লেখাপড়া বাদ দেয়। ছাত্র হিসেবে ক্লাসে ভালো ছিল। এরপর থেকে জাহাঙ্গীর সম্পর্কে কিছু জানতাম না। এমনকি তাকে গ্রামেও কখনও দেখা যায়নি।
তবে স্থানীয় ও একাধিক প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর সম্পর্কে জানান, জাহাঙ্গীর সমসময় বাড়িতে একাকি থাকতো। গ্রামের তেমন কারও সঙ্গে মিশতো না। ৯-১০ বছর আগে গ্রামের একটি হাফিজিয়ার মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুর রহমান ওরফে এরশাদশের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। গভীর রাত পর্যন্ত জাহাঙ্গীর মাদ্রাসায় রুমে বসে তার সঙ্গে গোপনে গল্প করতো।
এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার সরকার জানান, জাহাঙ্গীর জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত ছিল। কয়েকবার অভিযান চালিয়েও পুলিশ-র‌্যাব তাকে খুঁজে পায়নি। সে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ব্যবসায়ী তরুণ দত্ত ও দেবেশ প্রমাণিক হত্যা মামলার চার্জশিটভূক্ত পলাতক আসামি।
/এআর/