বন্যার পানি কমলেও বানভাসীদের কষ্ট কমেনি

বাঁধে আশ্রয় নেওয়া গ্রামবাসী

গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তাসহ সব নদ-নদীর পানি কমায় বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তবে করতোয়া নদীর পানি বৃহস্পতিবার (২৪ আগষ্ট) সকাল পর্যন্ত গোবিন্দগঞ্জ কাটাখালি পয়েন্টে এখনো বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমতে থাকায় জেলার ১৬৫টি চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল ডুবে থাকায় বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট জেগে উঠছে। তবে কমেনি বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। বিশুদ্ধ পানি, খাবার, গো-খাদ্য ও ওষুধ সঙ্কটের পাশাপাশি ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন।

বন্যাকবলিত সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বন্যা কবলিত সাত উপজেলার ৯০টি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া ২০ হাজার ৩৫৩ জন এবং উচু বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অন্তত ৩০ হাজার মানুষের অনেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। এছাড়া যারা এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন এবং যারা খেয়ে না খেয়ে নিজের বসতবাড়িতে পড়ে আছেন তাদের অনেকেই বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কটে ভুগছেন। সব মিলে বানভাসী পরিবারের মানুষরা অসহায় অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

21076664_1286514321457924_149539454_nবালাসীর কাইয়াহাটে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া ফুলবানু বেওয়া বলেন, ‘১৫ দিন ধরে বাঁধে আছি। পানি আর খাবার না থাকায় কষ্টে আছি। কিন্তু কেই খোঁজ নিলো না। এখন বাড়িতে পানি নাই। কিন্তু কাঁদা থাকায় বাড়ি ফিরতে পারছি না।’

সাতার চরের পানিবন্দি জামাল, মোখলেছ বলেন, ‘পানিতে ডুবে থাকার পরেও কোন সহায়তা পাননি। নিজের খাবার তো নাই, তার ওপর গবাদী পশুর খাবার নিয়ে চরম বিপাকে আছি। এখন বানের পানি কমলেও সব খানে কাঁদা থাকায় হাঁটাচলা করা কষ্ট। তার ওপর আবার দেখা দিয়ে জ্বর-সর্দিসহ পানিবাহিত রোগ।’

চর থেকে আসা বালাসী রেলের জায়গায় আশ্রয় নেওয়া রহিম, মোকছেদ, বেলাল মিয়া বলেন, ‘বানের পানিতে দিনরাত হাঁটাচলা করায় হাত-পায়ে ঘাঁ ধরছে। কিন্তু কোনও ওষুধ নাই। নিজেরও খাবার নাই গরুরও খাবার নাই। হামার মতো গরীবের এতো কষ্ট আর শাস্তি কেন তা আল্লাহই ভালো জানেন।’

উড়িয়া গ্রামের হাসেন আলী বলেন, ‘বানের পানি আসলে এক কষ্ট। আর পানি চলে গেলে হয় আরেক কষ্ট। তাছাড়া বানের পানিতে ধান, ফসলি জমি, পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় চরম ক্ষতি মুখে পড়েছি। এই ক্ষতি কেমনে পুষাব তা জানি না।’

21100955_1286514351457921_1134772696_n

অন্যদিকে জেলা প্রশাসন ও ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী জানা গেছে, দ্বিতীয় দফায় বন্যার পানিতে জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, পলাশবাড়ী ও সাদুল্যাপুর উপজেলার ৬০ ইউনিয়নসহ গোবিন্দগঞ্জ পৌরশহর প্লাবিত হয়। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় চার শতাধিক গ্রামের সাড়ে ৩ লাখ মানুষ। ডুবে যায় আমন ধান, ফসলি জমি ও পুকুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।

এছাড়া বন্যা কবলিত এলাকার ১৭৫ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা (আংশিক) ও দেড় কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে ১২টি ব্রিজ ও কালভার্ট। বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে এক নারীসসহ ৬  শিশু। এছাড়া বিদ্যুৎপৃষ্টে আরও এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ পাল বলেন, ‘আমরা বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য ত্রাণসহ সব ধরণের সহযোগিতা অব্যহত রেখেছি। ত্রাণ সামগ্রী ও নগদ টাকাসহ বানভাসীদের পাশে মেডিক্যাল টিম সার্বক্ষণিক কাজ করছে। তবে যারা ত্রাণ ও চিকিৎসা সেবা পাননি তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পূণর্বাসনসহ বিভিন্ন সহযোগীতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

21074469_1286514361457920_796900203_n

অন্যদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যার কারণে জেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। তবে এরইমধ্যে বেশ কিছু বিদ্যালয় থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো পাঠদান শুরু হয়নি। বন্যার পানিতে কোন বিদ্যালয়ের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা আর কয়েকদিন পর নির্ধারণ করা হবে। তবে এসব বিদ্যালয়ে দ্রুত পাঠদান শুরুসহ শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিকল্প ক্লাসের ব্যবস্থা করা হবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ খ ম রুহুল আমীন বলেন, ‘বন্যার কারণে জেলার বির্স্তীণ এলাকার আমন ধান, বর্ষালী ধান, শাক-সবজি, কলা ও পাটসহ ২৭ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। পানি কমে যাওয়ায় অনেক জমি জেগে উঠেছে। তবে ২০ হাজার জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে করে প্রায় এক লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষি পরামর্শ, বীজ ও ঋণ সুবিধাসহ সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হবে।’

আরও পড়তে পারেন: বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মাঝে আমন ধানের চারা বিতরণ করলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী