‘ফির যদি ধান না লাগাই তাইলে খামো কী’

00

বন্যায় জমির ফসল একবার নষ্ট হলেও থেমে নেই মহুবর রহমান। বন্যার পানিতে নষ্ট হওয়া ধানের জমিতে আবারও চারা লাগিয়েছেন তিনি। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের চৈতের খামার এলাকার ঘটনা এটি।

এ ব্যাপারে মহুবর বলেন, ‘কোনও বছর বানে আবাদ খায়া যায় না। এবার ছয় বিঘা জমির ধান বানে খায়া গেইছে। ফির (আবার) যদি ধান না লাগাই তাইলে খামো কী, গরু-বাছুর কী খায়া থাকপে (থাকবে)!’

মহুবর আরও জানান, তার গ্রাম হতে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের এক জায়গা থেকে ১০ হাজার টাকার ধানের চারা কিনে এনেছেন তিনি। পরিবহন ব্যয় বাঁচাতে নিজে ও দু’ছেলে ইব্রাহিম ও ওসমান মিলে বাইসাইকেলে করে ধানের চারা বহন করেছেন। এখন তাদের আশা, প্রকৃতি হয়তো আর বাধ সাধবে না, ক্ষতি কাটিয়ে আবাদ ঘরে তুলতে পারবেন তারা।

kurigram agri 4

চিলমারীর রানীগঞ্জ ইউনিয়নের প্রফুল্ল চন্দ্র, আজাহার মিয়া ও মাহফুজার রহমানসহ ইউনিয়নের রাধাবল্লব গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত সব কৃষক নিজেদের চেষ্টায় আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। বন্যায় জমির রোপা আমন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ওই জমিতে আবারও ধানের চারা রোপন করছেন। চারা কেনার টাকা যোগাড় করতে কষ্ট হলেও তাতে থেমে নেই এই গ্রামের কৃষকরা। কৃষক প্রফুল্ল চন্দ্র বলেন, ‘আগত্ (আগে) নিজের বিচন (ধানের চারা) দিয়া জমি গাড়ছি (ধান রোপন করেছি)।  সউগ (সব) বানের পানিতে পঁচি গেইছে। এবার মাইনষের টেই (মানুষের কাছে) ছয় হাজার টাকার বিচন কিনছি। গ্রামের ম্যালা মাইনষের ধান নষ্ট হইছে। কিন্তু হামরা কোনও সরকারি সাহায্য পাই নাই।’

কেমন করে সবাই আবার ধানের চারা লাগাচ্ছেন সে ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রফুল্ল চন্দ্র জানান, ‘হামার এবার খরচ উঠপার নয়, লচ হইবে। তারপরও ধার দেনা করি ধান লাগবার লাগচি, ধান নাগাইলে ( লাগালে) কামলা বাঁচে ( দিনমজুর বাঁচে), প্যাট (পেট) বাঁচে, গরু-বাছুর বাঁচে।’

প্রফুল্ল কিংবা মহুবর, এমন কয়েক হাজার কৃষক এবার আবাদের উৎপাদন খরচ ওঠাতে পারবেন না জেনেও ফসল ফলানোর চেষ্টা করছেন। বন্যার পানি যেসব জমির ফসল নষ্ট করে পলি ফেলে গেছে, সেই পলিযুক্ত জমিতে আবারও নিজেদের স্বপ্ন বুনছেন তারা। লাভ কিংবা লোকসানের চিন্তা না করে ফসল ফলানোর নেশায় আর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে স্বপ্ন বুনছেন এই অদম্য বানভাসি কৃষকেরা।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমিতে আবারও রোপা আমনের চারা এবং ছিটানো আমন বুনে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন কৃষকরা। বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে আবারও ফসল লাগিয়েছেন তারা। কোনও কোনও ফসলি জমিতে বন্যার পানিতে ভেসে আসা কচুরি পানা ও আবর্জনা জমে আছে। সেগুলোও পরিষ্কার করে চারা রোপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন স্থানীয় কৃষকরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, খামার বাড়ি সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় কুড়িগ্রামে নয় উপজেলায় ৬২টি ইউনিয়নে প্রায় পঞ্চাশ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। তবে প্রায় ৩৪ হাজার নয়শ’ ২৭ হেক্টর জমির রোপা আমন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন জেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, খামার বাড়ির উপ-পরিচালক মো. মকবুল হোসেন জানান, ‘এবারের বন্যায় জেলায় প্রায় সাতশ’ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে রোপা আমনের চারা এবং ৮০ জনকে বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। অন্যান্য কৃষকদের পূর্ব প্রস্তুতি ও সামর্থ থাকায় তারাও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আগামী রবি মৌসুমে কৃষকদের কাছে আগাম ভূট্টা, আলু ও চিনা বাদামসহ বিভিন্ন শষ্যের বীজ পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে চাহিদাও পাঠানো হয়েছে।’

44

কুড়িগ্রাম জেলার কৃষকদের যথেষ্ট কর্মদক্ষতা রয়েছে উল্লেখ করে এই কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের জেলায় ৮২ হাজার ছয়শ’ ৩৮ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও আমরা সে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পেরেছি। বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে ইতোমধ্যে এক লাখ নয় হাজার তিনশ’ ৯১ হেক্টর জমিতে ধানের চারা লাগানো হয়েছে, আগামী কয়েক দিনে এই পরিমাণ আরও বাড়বে। এটা শুধুমাত্র স্থানীয় কৃষকদের কর্মদক্ষতা ও শ্রম দেওয়ার মানসিকতার জন্যই সম্ভব হয়েছে।’

এবার জেলায় দুই লাখ ১১ হাজার নয়শ’ ২৭ মেট্রিকটন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে উল্লেখ করে মো. মকবুল হোসেন জানান, বন্যার ক্ষতির কারণে স্থানীয় কৃষকরা হয়তো উৎপাদন ব্যয় ওঠাতে পারবেন না। তবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে জেলার বাইরে ধান ও চাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।