এদিকে সীমান্তে হঠাৎ করে বিএসএফের এমন বেপরোয়া আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। তাদের ভাষ্যমতে, গত কয়েক বছরে বিজিবির তৎপরতায় সীমান্ত হত্যা অনেক কমে এসেছিল। তবে সম্প্রতি বিএসএফ হঠাৎ করেই সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে। এটা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। তারা ১৭১ বিএসএফের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কমান্ড্যান্ট রাকেশ সিনহার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
সীমান্ত হত্যার বিষয়ে ৫০ বিজিবির পরিচালক লে. কর্নেল তুহীন মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, ‘প্রতিটি পতাকা বৈঠকেই সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কমিয়ে আনার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। যে কারণে সীমান্তে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।’
জানা যায়, বিএসএফের গুলিতে গত ২৮ জানুয়ারি রাণীশংকৈল উপজেলার জগদল সীমান্তে বাবু (১৪) নামের এক কিশোর নিহত হয়। এছাড়া ১৮ জানুয়ারি একই উপজেলার ধর্মগড় সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ যায় জাহাঙ্গীর আলমের (২১)। এর চারদিন পর ২১ জানুয়ারি হরিপুর উপজেলার মিনাপুর সীমান্তে মো. জেনারুল হক (২২) নামে আরেক যুবক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান। গত ২৪ জানুয়ারি কান্তিভিটা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করার দায়ে এক শ্রমিককেও আটক করে বিএসএফ।
এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে সীমান্ত উপজেলা হরিপুরের সাংবাদিক কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ উপজেলায় গত ১০ দিনে বিএসএফের গুলিতে দুইজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনা কূটনৈতিক তৎপরতা ও দু’দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি বিজিবির তৎপরতা বৃদ্ধি ও কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সীমান্তে হত্যা বন্ধ করার জোর দাবি জানান।
রাণীশংকৈল উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোবারক আলী বলেন, ‘বাংলাদেশি কেউ সীমান্ত পার হলেই তাকে হত্যা করতে হবে কেন? বরং এ জন্য অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিএসএফ বেপরোয়া হয়ে ওঠায় সেটা হচ্ছে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
এদিকে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে। সীমান্তের ওপারের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন অধিবাসীরাই এ তথ্য জানিয়েছেন।
ধর্মগড় সীমান্তবাসী আজগর আলীর মতে, বেকার থাকায় দরিদ্র মানুষ ভারতে কাজ খুঁজতে যান, অনেকে সেখানে শ্রমিকের কাজও করেন। গত ২৪ জানুয়ারি কান্তিভিটা সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে আটক বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিক শাহ আলম অভাবে পড়ে কাজ করার জন্য অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিল।
এছাড়া দেশ ভাগ হওয়ার পরও স্বজনদের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সম্পর্ক শেষ করা যায়নি। তাই দু’পারের স্বজনদের মধ্যে আসা যাওয়া এখনও আছে। এ যাতায়াতের সময় অনেক সময় গুলিতে বাংলাদেশিরা নিহত হন। নিহত কিশোর বাবু এমনই ঘটনারই শিকার। সে তার ভারতীয় স্বজনদের দাওয়াতে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে পরিবার ও স্বজনরা।
এদিকে বিএসএফ সংযত হলে হত্যাকাণ্ড এড়ানো যায় বলে মনে করেন ঠাকুরগাঁওয়ের মানবাধিকার কর্মী আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত এমন কোনও তথ্য আমরা পাইনি যে বিএসএফ যাদের হত্যা করেছে তারা অস্ত্রধারী বা আক্রমণাত্মক ছিল। তারা অন্যায়ভাবে প্রবেশ করে থাকলে সহজেই জীবিত অবস্থায় ধরা সম্ভব হতো। তা না করে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না।
ঠাকুরগাঁও জেলার সীমান্ত এলাকা মোট ১৬২.৬৮ কিমি। এরমধ্যে বিজিবির ঠাকুরগাঁও সেক্টরের অধীনে রয়েছে ৯৭.৬৮ কিমি এবং দিনাজপুর সেক্টরের অধীনে রয়েছে দক্ষিণ ঠাকুরগাঁওয়ের ৬৩ কিমি কিমি। এই বিস্তীর্ণ এলাকার অধিকাংশ স্থানেই এখনও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। ফলে বিজিবির পেট্রোল ডিউটি ও চোরাচালানবিরোধী অভিযানে বেশ বেগ পেতে হয়। স্বল্প সংখ্যক বিজিবি সদস্য নিয়ে সীমান্তের সব অংশে সার্বক্ষণিক নজরদারিও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে সীমান্ত এলাকার উন্নয়ন এবং কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সীমান্ত হত্যা কমানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক।