নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সেই সুমি (ভিডিও)

সুমি আক্তারসৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার সুমি আক্তার বাড়ি পৌঁছেছেন। বাবা-মায়ের কাছে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) বিকালে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে তাকে পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইইএনও) কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর ঢাকা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সে করে সুমি বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়িতে ফিরে যান। তার বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতি সেনপাড়া গ্রামে। এ সময় সুমি সৌদিতে থাকা প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসে তার ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দেন।

সুমি জানান, তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। দুই বছর আগে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নেন। সেখানেই আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়। ৬ মাস পর তাকেই বিয়ে করেন। ৩০ মে স্বামী নুরুল ইসলামের পরামর্শে ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজে’র মাধ্যমে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদি আরবের রিয়াদে যান। সপ্তাহ খানেক পর থেকেই প্রথম কর্মস্থলে মালিক তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও মারধর করেছে। হাতের তালুতে গরম তেল ঢেলে দিতো ও রুমে আটকে রাখতো। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই মালিক তাকে না জানিয়ে সৌদি আরবের ইয়ামেন সীমান্ত এলাকা নাজরানের এক ব্যক্তির কাছে প্রায় ২২ হাজার রিয়ালে বিক্রি করে দেন। ওই মালিকও তাকে নির্যাতন করতো। উদ্ধার হওয়ার আগে ১৫ দিন তাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয়নি। তার মোবাইলফোনটিও কেড়ে নিয়েছিল। এক সময় খুব কান্নাকাটি করে স্বামীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য মোবাইলফোনটি চেয়ে নেন। বাথরুমে গিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করেন। সেই ভিডিওতে নির্যাতনের কথা জানান এবং স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে ওই ভিডিও তার স্বামী ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবহিত করেন। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সুমিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়।

সুমি বলেন, ‘সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশি কনসুলেট আব্দুল হক সৌদি পুলিশের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’

সুমি আরও জানান, বাবা-মায়ের নিষেধ অমান্য করেই স্বামী নুরুল ইসলামের কথা মতো সৌদিতে যান তিনি। দালালচক্র যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে, সে কথা তিনি প্রথমে জানতেন না। মালিকের (কফিল) কাছে জানতে পারেন, বাংলাদেশি প্রায় চার লাখ টাকায় তার কাছে সুমিকে বিক্রি করা হয়।


সুমি বলেন, ‘প্রতি রাতেই শরীরের ওপর চলতো নির্যাতন। প্রতিবাদ করলেই মারধর। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু, তাতেও রেহাই পেতাম না। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারতাম সেটা। শুধু তাই নয়, অন্যত্র বিক্রি করার পর সেখানেও আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। কাজ করতে গিয়ে কেন আমাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হলো।’

বিদেশ যাওয়ার আগে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ঢাকা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে ১ মাসের গৃহকর্মীর প্রশিক্ষণ নেন সুমি।

‘রূপসী বাংলা ওভারসিজে’র মালিক ভালো কাজের কথা বলে (হাউস কিপিং) তাকে সৌদিতে পাঠায় দাবি করে সুমি বলেন, ‘তারা আমাকে ভিসা ও টিকেট দেয়। কিন্তু, আমি যে ৪ মাস সেখানে কাজ করেছি। এজন্য মাত্র ১৫ হাজার টাকা আমার স্বামীর হাতে দিয়েছে। আর কোনও টাকা আমাকে দেওয়া হয়নি।’

উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে সুমি আক্তারস্বামী নুরুল ইসলাম জানান, মিরপুর-১ এলাকার সাজেদা বেগম নামের এক দালালের মাধমে সুমি বিদেশ যান। সাজেদা বেগমের সঙ্গে ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজের’ মালিক আকতার হোসেন ও তার কয়েকজন সহযোগী তাকে সৌদি আরবে পাঠায়। তারা মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তিনি রাজধানীর পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

সুমির মা মল্লিকা বেগম বলেন, ‘নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর একদিনও স্বস্তিতে ঘুমাতে পারিনি। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’

সুমির বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, অভাব-অনটনের সংসারে কিছু টাকা কামানোর জন্য বিদেশে গিয়েছিল মেয়েটা। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন নির্যাতনের শিকার হতে হবে।

পাঁচপীর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির প্রধান জানান, সুমিকে তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার স্বামীর কথা মতোই সে সৌদিতে যায়। সৌদিতে যারা এভাবে গৃহকর্মীদের নির্যাতন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

বোদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ মাহমুদ হাসান জানান, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে তাকে আমাদের এখানে পাঠানো হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামালের উপস্থিতিতে সুমিকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তার কোনও সহযোগিতা প্রয়োজন হলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছে।

শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সে সময় ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের পরিচালক ও উপ-সচিব মো. জহিরুল ইসলাম বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়। বিকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বোদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ মাহমুদ হাসান ও পাঁচপীর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর প্রধানের উপস্থিতিতে সুমিকে তার বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মল্লিকা বেগমের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, সুমির বাবা রফিকুল ইসলাম দিনমজুর। চার-ভাই বোনের মধ্যে সুমি বড়। নূরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ের পর জানতে পারেন, আগেও একটি বিয়ে করেছেন তার স্বামী। বাধ্য হয়ে সতীনের সঙ্গে সংসার শুরু করেন। বিয়ের দেড় বছর পর তার একটি সন্তান হয়।