কুড়িগ্রাম সদরে ৪ শতাধিক স্কুলছাত্রীর বিয়ে

করোনা মহামারিতে সংক্রমণ রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেড় বছরে কুড়িগ্রাম সদরের ৫১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩০টি মাদ্রাসার ৪০৭ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। একই সময়ে ঝরে পড়েছে এক হাজার ৯৪৬ শিক্ষার্থী। যাদের বেশিরভাগ শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে ভোগডাঙা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ৯২ স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। মাদ্রাসা পর্যায়ে একক প্রতিষ্ঠানে সর্বাধিক বিয়ে হয়েছে ৪৮ জনের, এটি রাজারহাট জাওহারিয়া দাখিল মাদ্রাসা।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সদরের ৮১টি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ৯৪৬ জন শির্ক্ষাথী ঝরে পড়েছে। এদের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরাও আছে।

জেলার নয় উপজেলার মধ্যে এ পর্যন্ত ছয় উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে নাগেশ্বরী উপজেলার স্কুলছাত্রীরা। এই উপজেলায় ৫৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩৮টি মাদ্রাসা মিলে ৫৭৭ স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।

সদর, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, ভূরুঙ্গামারী, চিলমারী ও রাজীবপুর উপজেলা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছয় উপজেলায় দুই হাজারের বেশি স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সদরে ৪০৭, নাগেশ্বরীতে ৫৭৭, ফুলবাড়ীতে ৫২৩, ভূরুঙ্গামারীতে ১৬০, চিলমারীতে ১৫৪ এবং রাজীবপুরে ২৫৫ স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।

তবে রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার প্রতিবেদন এখনও প্রস্তুত হয়নি বলে জানিয়েছেন দুই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। বিয়ে হয়ে যাওয়া ছাত্রীদের অনেকে বিদ্যালয়ে ফিরতে শুরু করেছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

নাগেশ্বরী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এত বেশি স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাবে- কল্পনাও করতে পারিনি। গত দেড় বছরে এসব বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয়েছে। তবে বিয়ে হয়ে যাওয়া অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফিরতে শুরু করেছে। আমরা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রসঙ্গে এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে বিদ্যালয় খোলার পর যারা ক্লাসে আসছে না তারা ঝরে পড়েছে। কিন্তু এই সংখ্যা এখন নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুল আলম বলেন, ‘এখনও সব উপজেলার তথ্য হাতে এসে পৌঁছায়নি। আমরা সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। সবগুলো উপজেলার তথ্য পেলে বাল্যবিয়ের শিকার শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেভাবে বাল্যবিয়ে বেড়েছে তাতে ভাবনায় পড়েছি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে গেলে প্রশাসনের সহায়তা দরকার। এটি প্রতিরোধ করতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্ম খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব বাল্যবিয়ের কথা জানেন উল্লেখ করে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জেলা রেজিস্ট্রারসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’

কেন বাল্যবিয়ে বেড়েছে জান‌তে চাই‌লে সদর উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূ‌রে তাস‌নিম (অতিরিক্ত দা‌য়িত্বপ্রাপ্ত) ব‌লেন, বাল্যবি‌য়ে নি‌রোধ ক‌মি‌টি স্বাভা‌বিকভা‌বে মাঠকর্মী‌দের দি‌য়ে এবং বিদ্যালয়গু‌লো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। বাল্যবি‌য়ে রোধের এই‌ দুটি হ‌লো বড় সূত্র। লকডাউ‌নের সময় বিদ্যালয় বন্ধ ছি‌ল, যুব মাঠকর্মী‌দের কার্যক্রম কিছুটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। কারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। তখন তথ্যগুলো আমা‌দের কা‌ছে ঠিকমতো পৌঁছায়‌নি। বাল্যবিয়ের স্থানগুলো আমরা নির্দিষ্ট করতে পারিনি। অবস্থান নিশ্চিত হওয়া ক‌ঠিন হ‌য়ে‌ পড়েছিল। স্বাস্থ্যবি‌ধি মেনে সবাই ঘরে ঢুকে যাওয়ার সুযোগে গোপনে এসব বিয়ে হয়েছে।

কা‌জি‌ এবং ইমাম‌দের গাফিলতি ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও ব‌লেন, প্রত্যেক ইউনিয়‌নে কা‌জি এবং ইমামের বিকল্প লোক আছেন। কা‌জিরা বাল্যবি‌য়ে‌তে না যাওয়ায় অন্যদের দিয়ে বি‌য়েগু‌লো পড়া‌চ্ছে তারা। যেগু‌লোর ‌বে‌শিরভা‌গের বৈধ কোনও নিবন্ধন হ‌য় না।