ঘাঘট নদীর পাড়ে ৫ শতাধিক লাশ পুড়িয়ে ফেলে হানাদার বাহিনী

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের দিন সোমবার (২৮ মার্চ)। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে এক অনন্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল রংপুরের বীর বাঙালি। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন কয়েকশ মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরেও জাতীয়ভাবে সেদিনের স্বীকৃতি মেলেনি।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরই নগরীর নিসবেতগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় ট্যাংক ডিভিশনের প্রধান ঘাঁটি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের প্রস্তুতি নেন রংপুরবাসী। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৮ মার্চ হাজার হাজার মুক্তিকামী বীর জনতা লাঠি, তীর-ধনুকসহ দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে আসেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন শত শত সাঁওতাল। তারা তীর-ধনুক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ে অংশ নেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী বৃষ্টির মতো মেশিনগান দিয়ে গুলি ছোড়ে। এতে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন অনেকেই। 

ওই দিন গভীর রাতে ক্যান্টনমেন্টের পাশে ঘাঘট নদীর পাড়ে পাঁচ শতাধিক মানুষের লাশ পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের বিষয়টি ছিল সাহসিকতার ঘটনা। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি মেলেনি।

ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াছ আহমেদ ও ছাত্রনেতা অলক সরকার জানান, আমরা মূলত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ হই। সেসময় প্রয়াত সংসদ সদস্য সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে রংপুরে বেশ কয়েক দফা গোপন সভা করা হয়। ওই সভায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত রফিকুল ইসলাম গোলাপ, ছাত্রনেতা অলক সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আমজাদ হোসেনসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় ২৮ মার্চ সকালে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় ছাত্র জনতা একত্রিত হবে। সেখান থেকে সবাই মিলে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন দিন আগে থেকে রংপুর শহর ছাড়াও মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ ও গঙ্গাচড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। 

তারা জানান, মিঠাপুকুরের বলদীপুকুর ও আশপাশের সাঁওতাল এলাকায় গণসংযোগ করা হয়। তারা তীর-ধনুক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। ২৮ মার্চ সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে দা-ছুরি, যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে চলে এসেছিল। প্রথমে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করেন রংপুর সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত আমজাদ হোসেন। সভায় বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য প্রয়াত সিদ্দিক হোসেন, প্রয়াত ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম গোলাপসহ বেশ কয়েকজন। সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ৫০০ গজের কাছাকাছি পৌঁছালে হানাদার বাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে শত শত মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। পরে হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। হানাদার বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট হামলার খবর শুনে এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিল যে, খালি হাতে আক্রমণ করা জনতাকে রুখতে ট্যাংক-কামান ব্যবহার করেছিল। পরে পাঁচ শতাধিক লাশ রাতের আঁধারে ঘাঘট নদীর পাড়ে পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে তারা। ফলে নিহতদের লাশ পায়নি স্বজনরা। এ ঘটনা সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ঘটনা সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহীদ আহাদ আলীর ছেলে মো. শরফুদ্দীন  বলেন, আমার বাবা দেশ ও দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিতে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। এজন্য আমরা গর্বিত। তবে দুঃখ একটাই, দীর্ঘ ৫১ বছরেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিনের স্বীকৃতি মেলেনি। আমরা দিনটির স্বীকৃতি চাই। 

একই কথা বললেন শহীদ মাহতাব হোসেনের ছেলে আখতার হোসেন। তিনি বলেন, পাঁচ শতাধিক বাঙালি শহীদ হয়েছিলেন সেদিন। অথচ আজো দিনটির স্বীকৃতি মেলেনি।

শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হোক।

রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু সরকার বলেন, ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের আহ্বান জানাই। একই সঙ্গে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করে নতুন প্রজন্মকে এই দিনের ইতিহাস জানানোর দাবি জানাই।