পারিবারিক কলহে বাড়ছে ‘আত্মহত্যা’

পরিবারতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কলহ, মনোমালিন্য কিংবা ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ নিত্যদিনের ঘটনা। তবে এই সমস্যাগুলো প্রতিনিয়ত মানসিক সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। ফলে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। অতিরিক্ত মানসিক চাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন তারা, এমনটি জানিয়েছে পুলিশ ও চিকিৎসকরা।

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা চলতি বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১টি। উপজেলায় গড়ে প্রতি মাসে দুই জন নানা কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক ও বিষপানের ঘটনা বেশি। তবে আত্মহত্যার চেয়ে আত্মহত্যাচেষ্টা ঘটনা কয়েক গুণ বেশি।

ঘোড়াঘাট থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত এ উপজেলায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১টি। এর মধ্যে ছয় জন পুরুষ এবং পাঁচ জন নারী। এসব ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন চার পুরুষ এবং তিন নারী। দুই পুরুষ এবং দুই নারী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। 

আত্মহত্যার ঘটনায় ঘোড়াঘাট থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ১১টি। সবগুলো মামলায় ময়নাতদন্তে প্রতিবেদনে আত্মহত্যার বিষয়টি উঠে এসেছে। মারা যাওয়া সবার বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। 

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এ উপজেলায় আত্মহত্যা রোধে সরকারি সংস্থা বা প্রশাসনের তেমন কোনও সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই। পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের কথা জানে না স্থানীয়রা। 

স্থানীয় সুশীল সমাজের লোকজনের দাবি, সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। তাদের মতে, আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা আত্মহত্যার একটি বড় কারণ। 

মনোচিকিৎসকদের মতে, আত্মহত্যার প্রবণতা তরুণ-তরুণীদের মাঝেই বেশি। যারা আত্মহত্যা করেন তাদের ৯৫ শতাংশ কোনও না কোনও মানসিক রোগে ভোগেন। তাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়।

ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি জুন মাস পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনার রোগী এসেছেন ৩২ জন। এসব রোগী কীটনাশক, গ্যাসের ট্যাবলেট অথবা মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে পুরুষ ১৭ এবং নারী ১৫ জন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এসব রোগীর তিন জনের শরীরে বিষক্রিয়া মারাত্মক হারে ছড়িয়ে পড়ায় মারা গেছেন। বাকিরা চিকিৎসায় বেঁচে ফিরেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আজাদুল ইসলাম বলেন, উপজেলার সিংড়া গ্রামের শামীম হোসেনের সঙ্গে গোবিন্দগঞ্জ থানার এক তরুণীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু মেয়ের পরিবার প্রেমের সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় গত মাসে মেয়েটি গ্যাসের বিষাক্ত ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে। প্রেমিকার মৃত্যুর শোকে গত রবিবার রাতে শামীমও বিষাক্ত গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে অসুস্থ হন।পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। 

ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তৌহিদুল আনোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় বিষপানের সঙ্গে সঙ্গে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনরা। এক্ষেত্রে বিষক্রিয়া পুরো শরীরে ছড়িয়ে না পড়লে তাদের বাঁচানো সম্ভব হয়। অনেক সময় দেরিতে আনায় বাঁচানো সম্ভব হয় না। তবে উপজেলার হাসপাতালগুলোতে ভেন্টিলেটর সুবিধা থাকলে বিষক্রিয়া রোগীর শরীরে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের বাঁচানো যেতো।’

ঘোড়াঘাট-হাকিমপুর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার শরিফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘোড়াঘাট থানায় আত্মহত্যার সবগুলো ঘটনার পেছনেই রয়েছে পারিবারিক নানা ধরনের সমস্যা। স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী কিংবা স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর মনোমালিন্য। ছোটখাটো এসব সমস্যায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অধিকাংশ নারী-পুরুষ। এছাড়া বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া, অভিমান, প্রেম বিরহ ও বিচ্ছেদে অনেকেই আত্মহত্যা করেন। আমরা আত্মহত্যা রোধে বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি।’