সরল সুদের কথা বলে নেওয়া হচ্ছে চক্রবৃদ্ধি সুদ!

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০০ কোটি টাকার রূপালী ব্যাংকের কর্পোরেট ঋণের সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ সরল। কিন্তু ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে সরল কথাটি বাদ দিয়ে চুক্তি হয়। ফলে ৪০৪ জন ঋণগ্রহীতা সরল হিসেবে সুদের কথা জানলেও তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে চক্রবৃদ্ধি হারে।

শুধু তাই নয়, করোনাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী কিস্তি আদায় বন্ধ এবং পরবর্তী সময়ে সেই কিস্তি অতিরিক্ত মাসে দেওয়ার নিয়ম হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগটি দেওয়া হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বরতদের খামখেয়ালীর কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে অন্ধকারে রেখে এই চুক্তিটি করা হয়। এ নিয়ে ঋণগ্রহীতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ও রূপালী ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সফিউল আলম এবং রূপালী ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ব্যবস্থাপক পবিত্র কুমার রায়। ওই সময়ে মোট ৪০৪ জন মোট ১৩০ কোটি টাকার ঋণ নেন। যার মধ্যে শিক্ষক ১০৫ জন, কর্মকর্তা ১০৮ জন ও কর্মচারী ১৯১ জন।

ঋণগ্রহীতাদের তখন জানানো হয়েছিল, ঋণের টাকা ৯ শতাংশ সরল সুদে ১৮০টি কিস্তির মাধ্যমে ১৫ বছরে পরিশোধ হবে। এতে করে প্রতি মাসে প্রতি লাখ টাকায় ১০১৫ টাকা করে ইএমআই (ইক্যুয়াল মান্থলি ইনস্টলমেন্ট) দিতে হবে। এরই মধ্যে তারা ৫২ মাসের মধ্যে ৩৭ মাসের ইএমআই দিয়েছেন। মাঝখানে করোনাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার হিসেবে ১৫ মাসের ইএমআই দেননি।

গত মাসে ঋণ গ্রহীতারা ব্যাংকের কাছে মূলঋণের কত টাকা কমেছে জানতে গিয়ে হেরফের দেখতে পান। পরে তারা জানতে পারেন যে, ৯ শতাংশ সরল সুদ নিয়মে যে ঋণ প্রদান করা হয়েছে তার ইএমআই সরল সুদে নয় বরং চক্রবৃদ্ধি বা অন্য উপায়ে নেওয়া হচ্ছে। এরপরই ঋণগ্রহীতারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করে। বিষয়টি জানার পর রূপালী ব্যাংকে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরইমধ্যে বিষয়টি রূপালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়। পরে রূপালী ব্যাংক বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেয়।

কয়েকজন ঋণগ্রহীতা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত প্রতিজন ঋণগ্রহীতা ৩৭ মাস কিংবা তারও বেশি কিস্তি (ইএমআই) পরিশোধ করেছেন। এসব ইএমআইয়ে যে অতিরিক্ত অর্থ আদায় হয়েছে তা সমন্বয় করতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সেই সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা জানিয়েছিলেন ঋণটি সরল সুদে। সেই হিসেবে ঋণ গ্রহণ করা হলেও তাদের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে ইএমআই গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অন্ধকারে রেখে এই কাজটি করেছেন তৎকালীন দায়িত্বরতরা। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর প্রফেসর ড. সফিকুল ইসলাম বলেন, যারা ঋণ নিয়েছি তাদের কাছ থেকে সরল সুদের বিনিময়ে অন্যভাবে ইএমআই গ্রহণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত যে অর্থ আমাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে তা যেন সমন্বয় করা হয় সে জন্য আমরা আবেদন জানিয়েছি, যদিও এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত আসেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সাইফুর রহমান বলেন, ওই সময়ে যে চুক্তি হয়েছিল সেই সময় চুক্তিতে সরল সুদ বা চক্রবৃদ্ধি কথাটি ছিল না। যারা ওই সময়ে চুক্তি করেছিলেন তাদের এটি দেখার কথা। চক্রবৃদ্ধি হারে যে টাকা প্রথম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে অতিরিক্ত সেই অর্থ সমন্বয় করার জন্য ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ৯ শতাংশ সরল সুদ থেকে ৮ শতাংশ সরল সুদ করার জন্যও বলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের ১৮০টি কিস্তি দিতে হবে। করোনার কারণে আমরা ১৫টি কিস্তি দেইনি। কিন্তু রূপালী ব্যাংক ১৫ মাসের ইএমআই মূলধনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন। আমাদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তিতে সরল কিংবা চক্রবৃদ্ধি কিছুই লেখা ছিল না, এটি এখন আমরা দেখছি। কিন্তু যারা এই ঋণের সুবিধা নিয়েছেন তারা বলছেন যে তাদের সরল সুদে ঋণ প্রদান করা হয়েছিল।

রূপালী ব্যাংক হাবিপ্রবি শাখার ব্যবস্থাপক গৌতম চন্দ্র রায় বলেন, যে চুক্তিটি হয়েছিল সেটি সংশোধনের জন্য আবেদন করেছে হাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ। সেই আবেদন আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে দিয়েছি। ২০১৮ সালের মার্চ মাসের চুক্তির সময়ে আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে পারছি না।

রূপালী ব্যাংক হাবিপ্রবি শাখার ওই সময়ে দায়িত্বরত ব্যবস্থাপক পবিত্র কুমার রায় বলেন, ওই সময়ে যে চুক্তি হয়েছে তা চক্রবৃদ্ধি হারেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এখন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের ঋণের অর্থ সরল সুদের কথা বলে দেওয়া হয়েছে এই দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। সেই সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন বিষয়টি তাদের। এ বিষয়ে এর চেয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।

চুক্তি ও ঋণের বিষয়টি মূলত যেসব বিভাগ বা যাদের ওপর বর্তায় তার মধ্যে রয়েছে রেজিস্ট্রার, অডিট শাখা ও হিসাব শাখা। চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ওই সময়ে দায়িত্বরত রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সফিউল ইসলাম মারা গেছেন।

তার মৃত্যুর পর থেকে দায়িত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট শাখার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। চুক্তিটি সরল সুদে নাকি চক্রবৃদ্ধি হারে ছিল তা জানাতে পারেননি তিনি। দেলোয়ার হোসেন বলেন, চুক্তিপত্র দেখতে হবে, চুক্তিপত্র আমার কাছে নেই। সমস্যা আছে সমাধান হবে।  ‘বিষয়টি তো ব্যাংক আর বিশ্ববিদ্যালয় সমাধান করবে। এটা নিয়ে তো পত্রিকায় লেখার মতো মতো কিছু আছে? এখন আপাতত নিউজ করার প্রয়োজন নাই’—বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।

ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন খান। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এই মুহূর্তে ভারতে রয়েছেন। তার দাবি, ‘চুক্তির কোনও কিছুতে আমাকে রাখা হয়নি। আমি পরিচালক থাকলেও আমাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। আমাকে চুক্তি দেখতে দেওয়া হয়নি, কোথাও আমার স্বাক্ষর নেই’।