‘আমারে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন’

সত্তরোর্ধ্ব আমেনা বেগম তার গ্রামে ময়না নামে পরিচিত। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে আশ্রয় চাচ্ছেন। স্বামী-সন্তান না থাকায় বসবাসের ঠাঁই হয়নি কোথাও। নিজের কোনও জমি কিংবা ঘর নেই। প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় হলেই ভাবেন, কোথায় রাতে থাকবেন। তখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য করুণা প্রার্থনা করতে হয়। আমেনার আকুতি, ‘আমার কেউ নাই, থাকার একটু জায়গা দেন, একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন।’

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মোল্লারহাট সংলগ্ন রসুলপুর গ্রামে যাযাবরের মতো আমেনার বসবাস। ওই গ্রামের মৃত আলিমুদ্দিন-ফুলজান বেগম দম্পতির মেয়ে তিনি। কখনও স্বজনদের বাড়িতে আবার কখনও গ্রামের কোনও পরিচিতজনকে অনুরোধ করে দিনরাত পার করছেন। খাবারের জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল এই বৃদ্ধা। একই গ্রামে ভাই থাকলেও ভিক্ষা করা সেই ভাইয়ের সংসারে ঠাঁই হয়নি। গ্রামের অসহায় নারীদের তালিকায় আমেনার নাম তাই সবার মুখে।

ঘরের আকুতি জানিয়ে আমেনা বলেন, ‘আমার কেউ নাই। শ্যাষ বয়সে একটু থাকার ব্যবস্থা করি দেন। একটা ঘরের ব্যবস্থা করি দিলে খুব উপকার হয়। শ্যাষ কয়টা দিন একটু শান্তিতে থাকবার চাই। মাইনষের বাড়ি বাড়ি থাকন লাগে, খাওন লাগে। কোনও সাহায্যও পাই না।’

সরকারি কোনও সহায়তা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে আমেনা বলেন, ‘বন্যা হইলে কিছু পাই। না হইলে কপালে কিছু জোটে না বাবা।’

ওই গ্রামের দিনমজুর মতিয়ার রহমান আমেনার ভগ্নিপতি। তিনি বলেন, ‘আমেনার আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনও ঘর নাই। তিনি একেক দিন একেক জনের বাড়িতে থাকেন। কখনও আমার বাড়িতেও থাকে, খায়। আমি নিজেও গরিব মানুষ। সবসময় তারে খাওয়ানো আমার সাধ্যে থাকে না।’

তিনি জানান, আমেনা বেগম কয়েক বছর আগে কাজের সন্ধানে জেলার বাইরে ছিলেন। পরে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়। তিনি সেখানে সংসার করেছিলেন। বছর খানেক আগে তার স্বামীর মৃত্যু হলে নিরুপায় আমেনা আবার গ্রামে ফিরে আসেন। তার কোনও সন্তান নেই। কোনও জমি বা ঘর নেই। বাকি জীবন স্বস্তিতে কাটানোর জন্য একটা ঘরের খুব প্রয়োজন। না হলে আসছে শীতে তার কষ্টের সীমা থাকবে না।’

ওই গ্রামের বাসিন্দা সাহেরা খাতুন আমেনার কষ্ট আর ভোগান্তির প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন যা পাই তাকে খাইতে দিই। কিন্তু তার তো একটা ঘর দরকার। মাইনষের বাড়িতে তো সবসময় থাকার ব্যবস্থা হয় না। আমেনা বেটির জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করলে শ্যাষ বয়সে মানুষটা একটু শান্তিত থাকবার পারলো হয়।’

স্থানীয়রা বলছেন, বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেওয়া হলেও আমেনার ভাগ্যে জোটেনি। অথচ জায়গা ও বাড়ি আছে এমন ব্যক্তিও আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন। আমেনাকে ঘর দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি।

রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ আইয়ুব আলী বলেন, ‘যার কিছু নাই সে ঘর পায় না। তারা তো ট্যাকা দিবার পারে না। তাগো কাছে মেম্বার-চেয়ারম্যানও যায় না। আমেনা খুব অসহায়। তার একটা ঘর পাওন লাগতো।’

আমেনার জন্য ঘরের ব্যবস্থা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওই গ্রামের দিনমজুর আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আমেনার মতো মাইনষের সাহায্য পাওন দরকার। কিন্তু পায় তো যারা ভালো তারাই। আমেনারা না পাইয়াই মরবো।’

আমেনার অসহায়ত্বের সত্যতা পাওয়া যায় বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়ার কথায়। তিনি বলেন, ‘সামনে ঘরের বরাদ্দ পাওয়ার কথা। ঘর পাইলে আমেনার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা হবে।’

জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গৃহনির্মাণ প্রকল্পের অধীন কুড়িগ্রামে ২৯০টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের জন্য ঘর বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে উলিপুর উপজেলায় ৭৫টি পরিবার এই প্রকল্পের ঘর পাবে। তবে সে প্রকল্পে আমেনা বেগমদের মতো দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিরা ঘর পাবেন কিনা না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।