জমে উঠেছে কান্তজিউ মন্দিরের রাস মেলা

‘দাদা নিয়ে যান, ২০ টাকা ২০ টাকা’ 

চারদিকে হই-হুল্লোড়, কানে ভেসে আসছে বাঁশির সুর। বাচ্চাদের বায়না, বড়দের আদর মাখানো শাসন কিংবা ধমক। সঙ্গে আছে ‘এই যে দাদা নিয়ে যান ২০ টাকা ২০ টাকা’, ‘কি লাগবে ভাই’, ‘দাদা এদিকে আসুন’ ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের এমন আহ্বান ও ডাকাডাকি। আবার কোনও দোকান থেকে ভেসে আসছে ক্রেতা-বিক্রেতার দরদামের কথা। এ চিত্র দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে রাস উৎসব উপলক্ষে জমে ওঠা মেলার। 

কান্তজিউ মন্দিরের এ রাস উৎসব ও মেলা আয়োজনের বয়স ২৭০ বছর। করোনার কারণে গত দুই বছরে তেমন উৎসব ও আয়োজন ছিল না। তাই এবারের উৎসব ও মেলা শুরু হতে না হতেই উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। বিকালের পর থেকেই বাড়ছে লোকসমাগম। আর মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্ত-পূণ্যার্থীদের সমাগম তো আছেই।  

ইতিহাস বলছে, প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। রাজা প্রাণনাথ ১৭০৪ সালে কান্তজিউ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরে তার পোষ্যপুত্র রামনাথ ১৭৫২ সালে কাজ শেষ করেন। ওই বছর থেকেই মন্দিরকে ঘিরে রাস উৎসব ও মেলা বসছে। এ উৎসব ও মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও শতশত নারী-পুরুষ ভক্ত-পূণ্যার্থী ও পর্যটকেরা যোগ দেন।

সোমবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাস উৎসব ও মেলা শুরু হয়। মাসব্যাপী এই উৎসব ও মেলা জমতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। দোকানিরা চুড়ি, ফিতা, কানের দুল, গলার চেইন, টিশার্ট, প্যান্ট, কাগজ ও প্লাস্টিকের ফুল, চশমা, পুতুলসহ হরেক রকমের খেলনা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেব-দেবীর মূর্তি বা প্রতিমা, পূজার প্রয়োজনীয় শংখ, করতাল, ঢোল, কাশা, বাঁশি, প্রদীপ, গাছা, জিলাপি, খুরমা, মণ্ডা-মিঠাই ও মিষ্টান্ন বিক্রি করছেন। কান্তজিউ মন্দিরের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে দোকানের সারি দেখা যাবে।  

পছন্দের জিনিসপত্র কিনতে দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন অস্থায়ী দোকানগুলোতে। পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা বেশ উপভোগ করছেন মেলা আয়োজন।  

আরও পড়ুন: ২৭০ বছরের ঐতিহ্য: কান্তজিউ মন্দিরে রাস উৎসব শুরু

নীলফামারীর জলঢাকা থেকে আসা বৃদ্ধ গনেশ্বর রায় বলেন, ১৫-১৬ বছর ধরে এই মেলাতে আসি। মেলা দেখতে খুব ভালো, বড় মন্দিরও আছে। তাই বারবার আসতে মন চায়। এখানকার উৎসব খুব ভালো, মধুময়।

বিরামপুর থেকে আসা সান্তনা রানী বলেন, মেলায় খুব ভালো লাগছে। স্বাধীনভাবেই কেনাকাটা করা যাচ্ছে। মন্দির দর্শন করলাম। তবে মেলায় আসা জিনিসপত্রের দাম বেশি মনে হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে মেলা ও মন্দিরের সুবিধা বেড়েছে।

বাশেরহাট থেকে আসা পূর্ণিমা রানী বলেন, রাসমেলা দেখতে এসেছি। ভগবানের প্রসাদও পেয়েছি। স ব মিলিয়ে ভালোই লেগেছে। ২০১২ সাল থেকেই এই মেলায় আসে। বাচ্চাদের পছন্দের জিনিস কিনেছি, গরম গরম জিলাপি কিনেছি। বাসায় গিয়ে সবাই মিলে খাবো।

রংপুর থেকে মেলায় এসেছেন কাকলী রায়। তিনি বলেন, কর্মসূত্রে বাইরে থাকি, সবসময় সুযোগ হয় না। এবারে সুযোগ পেয়েছি তাই এসেছি। যেহেতু এত বড় মেলা, শ্রীকৃষ্ণের দর্শনীয় স্থান তাই আসলাম। এখানে একেকজন একেক উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে। কেউ ভগবানের দর্শনের জন্য আসে, কেউ পরিবারের মানত ও সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে আসে। যারা আসে তারা ভালআ ফল পেলে পূজা দেন। 

করোনার কারণে দুটি বছর ব্যবসা মন্দা ছিল। এবার কিছুটা আশার আলো দেখছেন আগত অস্থায়ী দোকানের স্বত্বাধিকারীরা।

জামালপুর থেকে চুরি, দুলসহ বিভিন্ন প্রসাধনীর দোকান নিয়ে এসেছেন বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, জামালপুর থেকে এসেছি। প্রতিবছরই আসি। করোনার কারণে গত প্রায় তিন বছর ব্যবসা বন্ধ ছিল। এবারে ভালো বেচাকেনার আশা রাখি। 

খেলনার দোকানদার নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা বিরামপুর থেকে এসেছি। এবারে ভালো মেলা হবে বলে আশা করছি। 

জামাল হোসেন নামের এক দোকানি বলেন, এই মেলায় প্রতিবারই আসি। গত বছরে মেলা জমেনি। 

কাহারোল সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার রওশন আলী বলেন, যাতে এই মেলায় কোনও বিশৃঙ্খলা বা জঙ্গি হামলার ঘটনা না ঘটে সেজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে কড়া নরদারি রয়েছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কাজ করছেন বলে জানান তিনি।