অধিক মুনাফার লোভে সারা দেশের মতো দুবাইভিত্তিক মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) অ্যাপে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন কুড়িগ্রামের অনেকে। তাদের ফাঁদে পড়ে চর রাজিবপুর উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাহক নিঃস্ব হয়েছেন। এখানে তিন সিইওর মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে গেছে এমটিএফই। ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামিউল হাসান, নুর আলম হৃদয় ও ইউনুছ আলী নামে রাজিবপুরের তিন যুবক এমটিএফই’র সিইও হিসেবে গ্রাহকদের কাছে লোভনীয় প্রচারণা চালাতেন। সর্বশেষ গত জুলাই মাসেও ‘মেগা সেমিনার’ নামে কোম্পানির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এলাকায় একাধিক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন তারা। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এলাকার শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সুধী সমাজ ও আলেমদের যুক্ত করে মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন। বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি আস্থা দিতে স্ট্যাম্পে লিখে ও চেক জমা দিয়ে নিশ্চয়তার আশ্বাস দেন। একজনের বিনিয়োগের মুনাফার প্রচারণায় পরিচিত অন্যজন আগ্রহী হয়ে বিনিয়োগ করেন। এভাবে সহজ-সরল গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন। সংসারের জিনিসপত্র বিক্রি কিংবা ঋণ করে কেউ ২৫ হাজার টাকা আবার কেউ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হন। এখন লোকলজ্জা ও সংকোচে মুখ খুলছেন না অনেকে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ
উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের নয়ারচর গ্রামের বেকার যুবক মাইদুল (৩০)। এমটিএফই’র লোভনীয় আয়ের কথা শুনে পরিবার ও আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে ১ লাখ ১১ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। এতে তাকে সহায়তা করেন স্থানীয় আরেক ভুক্তভোগী যুবক রুবেল হোসেন। মাইদুলের আগে রুবেল বিনিয়োগ করেন ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই প্রতিনিধির কথা হয় মাইদুল ও রুবেলের সঙ্গে।
আরও পড়ুন: বাড়ির জমিজমা বন্ধক রেখে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করেছি, আমার সব শেষ
তারা জানান, উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নে এমটিএফই নিয়ে বিভিন্ন সময় সেমিনার আয়োজন করেন স্থানীয় যুবক ইউনুছ ও মুনির। মুনিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিপন স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে আগ্রহীদের অ্যাকাউন্ট খুলতে সহায়তা করতেন। ইউনুছ ও মুনির গাজীপুর থেকে এমটিএফই’র সদস্য হন। সেখান থেকে রিপনের মাধ্যমে এলাকায় কার্যক্রম চালাতেন।
কোম্পানির সঙ্গে জড়ানোর প্রসঙ্গে মাইদুল বলেন, ‘আমাদের এলাকায় সেমিনার করেছেন মুনির ও ইউনুছ। আমি সেমিনারে ছিলাম। পরে রুবেলের মাধ্যমে মুনিরের কাছে টাকা দিই। মুনির তার বন্ধু রিপনের কাছে গিয়ে আইডি খুলতে বলেন। এরপর আইডিতে ডলার কিনে দেন। কিন্তু আমি কোনও লাভের টাকা তুলতে পারি নাই। এখন মুনির আর রুবেল বলছে, টাকা নিয়া পালাইলে আমরা কী করুম।’
এ ব্যাপারে রুবেল হোসেন বলেন, ‘আমি নিজেও ধরা খেয়েছি। দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়ে মাত্র ৪০ হাজার তুলতে পেরেছি। বাকি টাকা নিয়ে গেছে তারা।’
এমটিএফই সম্পর্কে জানার বিষয়ে রুবেল বলেন, ‘মুনির ও ইউনুছ স্থানীয় নয়ারচর ফাজিল মাদ্রাসায় সেমিনার করতো। তবে তারা বলেছিল, কোনও গ্যারান্টি নাই। আপনারা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন। মুনির, ইউনুছ ও রিপনের মাধ্যমে এলাকার অন্তত ২০-৩০ জন এমটিএফই-তে টাকা দিয়েছে। প্রত্যেকে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা দিয়েছে। অনেকে ঋণ করে টাকা দিয়েছে। সবাই এখন ধরা খেয়ে বসে আছে।’
রিপনের বাড়ি নয়ারচরের পুরান বাজার গ্রামে। ফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, তিনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেন। মুনির তার বন্ধু। তিনি নিজে তিন মাস আগে ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
রিপন বলেন, ‘কেউ অ্যাকাউন্ট করতে চাইলে করে দিতাম। তবে আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিইনি। এগুলা নিয়ে প্রশ্ন করার আপনি কে?’
মুনিরের মাধ্যমে এমটিএফই-তে বিনিয়োগ করেন রাজিবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের পদধারী এক নেতা। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এক বড় ভাই ও এক বন্ধু মিলে জুলাইয়ের শেষ দিকে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছি। ১০ হাজার তুলতে পেরেছি। এরপর বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানি। এখন বিষয়টি নিয়ে মুনিরের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চলছে।’
রাজিবপুরের সিইও কারা?
রাজিবপুর উপজেলার বাসিন্দা জামিউল হাসান, নুর আলম হৃদয় ও ইউনুছ আলী এমটিএফই’র সিইও হিসেবে বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ইউনুছ আলীর বাড়ি উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের সংকরপুর পাড়া গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত ওয়াজেদ কাজীর ছেলে। ইউনিয়নে তার সহযোগী হিসেবে সেমিনারে অংশ নিতেন মুনির হোসেন। মুনির একই ইউনিয়নের আজমেরি পাড়া গ্রামের আবু সামার ছেলে। ইউনুছ ও মুনির দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরে থাকেন। এমটিএফই কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার পর থেকে তারা আর এলাকায় আসছেন না।
অপর দুই সিইও জামিউল হাসান ও নুর আলম হৃদয়ের বাড়ি রাজিবপুর সদর ইউনিয়নে। তারাও বর্তমানে এলাকায় নেই। মোবাইল নম্বরও বন্ধ তাদের। তবে রাজিবপুরে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: এক মোহন দাসের অধীনেই এমটিএফই-তে লেনদেন হতো ১০ কোটি টাকা
হৃদয়ের বাবা মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে সিলেটে থাকে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করে। এমটিএফই’র সদস্য হলেও এলাকার কাউকে ওটাতে জড়ায়নি। সিলেটে এসব নিয়ে কাজ করছে। এখন তার ফোন নম্বর বন্ধ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।’
তবে জামিউলের বাবা শহিদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। মুনিরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও ভুক্তভোগী। আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। যদিও আমি টাকা তুলতে পেরেছি।’
এলাকায় এমটিএফই নিয়ে সেমিনারে অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করে মুনির বলেন, ‘ইউনুছের সঙ্গে পরিচয় আছে। তবে আমি সিইও নই। কেউ বলতে পারবে না যে, আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরে থাকি। ফ্রিল্যান্সিং করে রোজগার করি। ভুক্তভোগীদের বিনিয়োগের দায় আমি নেবো না।’ অপরদিকে সিইও ইউনুছ আলী এলাকায় নেই। তার মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘এমটিএফই নিয়ে প্রতারিত কেউ তথ্য-প্রমাণসহ আমাদের কাছে আসলে আইনি সহায়তা দেবো। এ ছাড়া ভুক্তভোগীরা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সিআইডির সহায়তা নিতে পারেন।’