গরমে বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, রংপুর হাসপাতালে পাঁচ দিনে ২২ জনের মৃত্যু

রংপুরে প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। রোদের তাপে হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগবালাই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বিভাগের একমাত্র বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে তিল ধারণের জায়গা নেই রোগীদের। ওয়ার্ডের শয্যা তো দূরের কথা জায়গা নেই মেঝেতেও। গত পাঁচ দিনে ‘স্ট্রোকজনিত কারণে’ হাসপাতালে ভর্তি ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মেডিসিন বিভাগের সহকারী ওয়ার্ড মাস্টার ইউনুস খান জানিয়েছেন, প্রতিদিন রংপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে ৮ থেকে ১০ জন স্ট্রোকজনিত রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এর মধ্যে গত পাঁচ দিনে ২২ জন মারা গেছেন। ‘স্ট্রোকজনিত কারণে’ তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক।

এদিকে, মেডিসিন ওয়ার্ডের বেশিরভাগ সিলিং ফ্যান নষ্ট। যেগুলো সচল আছে সেগুলোও ভালোমতো ঘোরে না। একে তো রোগের যন্ত্রণা তার ওপর এমন গরমে রোগীদের দুর্ভোগের শেষ নেই।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, কার্ডিওলজি ও মেডিসিন বিভাগে রোগী সবচেয়ে বেশি। ওয়ার্ডগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। এর মধ্যে স্ট্রোকজনিত রোগী বেশি।

মেডিসিন ওয়ার্ডে দেখা গেছে, এই ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছেন শতাধিক। এর মধ্যে স্ট্রোকজনিত রোগী বেশিরভাগ। অনেকে এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন আছেন।

রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচণ্ড গরমে ডায়রিয়ার প্রকোপ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। অনেকে মাঠেঘাটে কাজ করতে গিয়ে স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে এসেও ঠিকমতো চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। সারা দিনে একবার চিকিৎসক আসেন। তাও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে দিয়ে চলে যান। ওষুধসহ সব ধরনের পরীক্ষা বাইরে প্রাইভেট ক্লিনিকে করতে হচ্ছে। তার ওপর ওয়ার্ডের বেশিরভাগ সিলিং ফ্যান বিকল। যা সচল আছে সেগুলোও ভালোভাবে ঘোরে না। ফলে প্রচণ্ড গরমে ভর্তি হওয়া রোগীরা আরও অসুস্থ হচ্ছেন। প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। 

তীব্র গরমে স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রামের রহমান আলী। এখন কিছুটা সুস্থ আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গরমে কৃষিজমিতে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। পরে চিকিৎসক জানান স্ট্রোক। তিন দিন ধরে ভর্তি আছি। তবে ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছি না।’

ঠিকমতো চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন মেডিসিন বিভাগে ভর্তি রংপুরের পীরগাছার মমতাজ বেগম, আনোয়ারা বেগম ও কুড়িগ্রামের আশরাফ আলী। স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি আছেন তারা।

পাঁচ দিনে স্ট্রোকজনিত কারণে ২২ জনের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. 
আ. ম. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘স্ট্রোকজনিত কারণে সবার মৃত্যু হয়েছে—এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে গরমে স্ট্রোকজনিত রোগী বেড়েছে। তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন। আবার অনেকে স্বাভাবিকভাবেই মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেক রোগীই মারা যান—এটা স্বাভাবিক ঘটনা।’ 

হাসপাতালে শয্যার চেয়ে দুই-তিন গুণ রোগী বেশি ভর্তি জানিয়ে উপপরিচালক আরও বলেন, ‘রোগীদের চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। ওয়ার্ডের সিলিং ফ্যানগুলো সচল আছে। বিকল হলেই সচলের ব্যবস্থা করা হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত অনেক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। যা অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। এজন্য চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। তারপরও সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।’

রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) রংপুর বিভাগের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া গাইবান্ধায় ৩৯ ডিগ্রি, দিনাজপুরে ৩৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি, রংপুরে ৩৮ ডিগ্রি, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট ও নীলফামারীর ডিমলায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ কামরুল হাসান জানিয়েছেন, বিভাগে এখন মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার তাপপ্রবাহ চলছে। এটা পুরো এপ্রিলজুড়ে অব্যাহত থাকবে। এরপরও চলতে পারে। তাপপ্রবাহ রোদের প্রখরতা ও গরমের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।’

প্রচণ্ড গরমে রংপুর নগরীতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষ। কাজে বের হলেও বেশিক্ষণ অবস্থান করতে না পেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি।