টিলাগড় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হচ্ছেন কর্মীরা

নিহত ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মুহাম্মদ মাসুম, ওমর মিয়াদ এবং তানিম খানআধিপত্য বিস্তার ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সিলেটের টিলাগড় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘাত-সহিংসতা নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত চার মাসে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মুহাম্মদ মাসুম, ওমর মিয়াদ এবং তানিম খান।

জানা গেছে, এমসি কলেজ, সরকারি কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অবস্থান পাশাপাশি। ফলে এখানে নিজেদের বলয় বাড়ানোর পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া ছাত্রলীগ। আর ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের মধ্যে একটি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রঞ্জিত সরকারের অনুসারী এবং অন্যটি মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের অনুসারী।

ছাত্রলীগ কর্মীদের অভিযোগ, সংঘর্ষে খুনের ঘটনায় মামলা হলেও দোষীদের আইনের আওতায় আনতে দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতি দেখা যায় না। ফলে বারবার রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে সিলেটের টিলাগড়।

পুলিশ ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে দুই গ্রুপের কোন্দলে খুন হন এমসি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠে টিলাগড়ের ছাত্রলীগ। এমসি কলেজের হল পোড়ানো, হল ভাঙচুর, অস্ত্রবাজি, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা। এছাড়া ২০১২ সালের ৮ জুলাই রাতে শিবির তাড়ানোর নামে মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসের ৩টি ব্লকের ৪২টি কক্ষ পুড়িয়ে দেয় ছাত্রলীগ।

জানা গেছে, বর্তমান টিলাগড় ছাত্রলীগের একটি অংশকে নেতৃত্ব দেন রঞ্জিত সরকারের অনুসারী হিরন মাহমুদ নিপু এবং অপর অংশের নেতৃত্ব দেন আজাদুর রহমান আজাদের অনুসারী ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রায়হান আহমদ চৌধুরী। আজাদুর রহমান আজাদ ও রঞ্জিত সরকার বন্ধু ছিলেন। তারা এক সঙ্গেই সিলেটে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। মিছিল মিটিং থেকে শুরু করে সবই তারা এক সঙ্গে করেছেন। এমসি ও সরকারি কলেজে আজাদ-রঞ্জিত গ্রুপও ছিল। রাজনীতির মাঠে তারা প্রতিপক্ষকে ঠেকিয়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। নিজেরাই গড়ে তুলেছেন টিলাগড় ছাত্রলীগ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নিজের বলয় বাড়াতে তারা দুই মেরুতে অবস্থান করেন। আধিপত্য আর বিরোধের কারণে ফাটল ধরে তাদের বন্ধুত্বেও।

প্রসঙ্গত, গত ৪ জানুয়ারি সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন করে রঞ্জিত গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এসময় তারা কলেজের ভেতরে শোডাউন করে।এমন খবর পেয়ে কলেজে অবস্থান নেওয়ার প্রস্তুতি নেয় আজাদ গ্রুপের কর্মীরা। একপর্যায়ে আজাদ গ্রুপের কর্মীরা মিছিল নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের ধাওয়া করে রঞ্জিত গ্রুপ। এসময় দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনার জের ধরে গত ৭ জানুয়ারি টিলাগড়ে আজাদ গ্রুপের অনুসারীদের হামলায় নিহত হন সিলেট সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তানিম খান। পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।

এছাড়া ২০১৭ গত বছরের ১৬ অক্টোবর আজাদ গ্রুপের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে খুন হন রঞ্জিত গ্রুপের অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী ওমর মিয়াদ। নিহত মিয়াদ সিলেট এমসি কলেজে বিএসএস এবং লিডিং ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এই হত্যাকণ্ডের পর রায়হান চৌধুরীকে প্রধান আসামি করে শাহপরাণ থানায় মামলা করা হলেও পুলিশ এখন কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ হত্যকাণ্ডের জেরেই বাতিল করা হয় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটিও।

একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জ এলাকায় প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। পূর্ব বিরোধের জের ধরে মাসুমকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। নিহত মাসুম সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শান্তিগঞ্জের মাসুক মিয়ার ছেলে। তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সমর্থিত সুরমা গ্রুপের কর্মী ছিলেন। হামলাকারীরা আজাদ গ্রুপের কর্মী ছিলেন বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল মাসুমের সহপাঠীদের।

রঞ্জিত গ্রুপের অনুসারী ও সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিরণ মাহমদু নিপু বলেন, ‘আজাদ ভাই ও রঞ্জিত দাদা এক সময়ে বন্ধু ছিলেন। ছাত্র অবস্থায়েই আমরা রঞ্জিত দাদার গ্রুপে যোগ দেই। সেই প্রক্রিয়াটি এখনও আছে। আমাদের গ্রুপের নেতাকর্মীরা সবাই ছাত্র হওয়ায় অন্য গ্রুপের ক্ষোভ আমাদের ওপর বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজাদ গ্রুপের অনুসারীরা বহিরাগতদেরকে নিয়ে এমসি ও সরকারি কলেজে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু তাতে বাধা দেয় আমাদের কলেজের নেতা-কর্মীরা। সেই ক্ষোভ তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের। যার কারণে তারা পরিকল্পিতভাবে আমাদের কর্মীদেরকে হত্যা করেছে।’ 

তবে কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদসহ তার গ্রুপের কয়েকজন নেতার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তাদের ব্যবহৃত ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘টিলাগড়ের ঘটনা নিয়ে আমরা খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার জন্য আজ (৯ জানুয়ারি) সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ 

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, ‘টিলাগড়ের ঘটনা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক। এসব ঘটনা আওয়ামী লীগ কোনভাবেই চায় না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আইনি প্রক্রিয়ায় চলবে। পাশাপাশি দলীয়ভাবেও আমরা এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেবো।’

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন,‘টিলাগড় ছাত্রলীগ নিয়ে আমরা খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি। বিষয়গুলো দলের হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফর শেষে উভয় গ্রুপকে নিয়ে বৈঠকে বসা হবে।’