ফসল রক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজন ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর হাওরের ফসল আগাম বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য হাওরের চারপাশে মাটি দিয়ে বাঁধ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি এস্কেভেটর বা খনন যন্ত্র ও সনাতন পদ্ধতিতে শ্রমিক দিয়ে মাটি কেটে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ করায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরে কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) কর্মসূচির মাধ্যমে ৫৫৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি মাধ্যমে জেলার ছোটবড়ো ৩৭টি হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সুনামগঞ্জ সদরে ৩ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার, বিশ্বম্ভরপুরে ১৫ দশমিক ২৩ কিলোমিটার, তাহিরপুরে ৫৫ দশমিক.৪৩ কিলোমিটার, ধর্মপাশায় ৫৫ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার, জামালগঞ্জে ৬১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ৩৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার, জগন্নাথপুরে ৩১ দশমিক ৮২ কিলোমিটার, ছাতকে ৪ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার, দোয়ারাবাজারে ১০ দশমিক ২২ কিলোমিটার, দিরাইয়ে ৭৪ দশমিক ২৬ কিলোমিটার, শাল্লায় ৯৯ কিলোমিটারসহ মোট ৪৪০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামের বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘গেলবারের চেয়ে এবছর এস্কেভেটর মেশিনের সংকট বেশি। সব হাওরে একসঙ্গে বাঁধের কাজ শুরু হওয়ায় পিআইসির লোকজন পর্যাপ্ত পরিমাণ এস্কেভেটর মেশিন পাচ্ছেন না। তাই ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ ঢিমেতালে চলছে।’
তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের নিবারন তালুকদার বলেন, ‘প্রতিবছর হাওরের বাঁধে মাটি দেওয়ায় এখন মাটির সংকট দেখা দিয়েছে। বাঁধের আশপাশের এলাকায় মাটি পাওয়া যায় না। অনেক দূর থেকে ট্রাকে করে মাটি এনে বাঁধে দিতে হয়। তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অসীম চন্দ্র তালুকদার বলেন, ‘এবছর হাওরের বাঁধ নির্মাণে মাটি সংকট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা-সিলেট চট্টগ্রাম থেকে এস্কেভেটর আনতে ৩/ ৪ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হয়। তাই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি লোকজন সহজে এস্কেভেটর হাওরে আনতে পারছেন না। তাই গতবছরের তুলনায় এবছর বাঁধ নির্মাণে অনেকটাই ধীরগতি রয়েছে।’
মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার এস্কেভেটর চালক মহসিন মিয়া বলেন, ‘একটি এস্কেভেটর দিয়ে সারা দিনে পাঁচ হাজার ফুট মাটি কাটা যায়। হাওরে বেড়িবাঁধের পরিমাণ বেশি। কিন্তু এস্কেভেটর কম থাকায় বাঁধ নির্মাণের কাজে গতি আসছে না।’
উমেদনগর গ্রামের সমীরণ দাস জানান, ‘এবছর বাঁধের কাজ অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে। মাঘ মাসের শেষ দিকে হাওর এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে বাঁধের কাজ শেষ করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।’
খিদ্দরপুর গ্রামের নূর মিয়া বলেন, ‘দ্রুত বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করা না হলে সারা জেলার বোরো ফসল আগাম বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে। এবছর জাতীয় নির্বাচনের কারণে বাঁধ নির্মাণের কাজ প্রায় এক মাস পিছিয়ে গেছে। তাই সবাই মিলে উদ্যোগ না নিলে হাওরের ফসর হুমকির মুখে পড়বে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপারিচালক মো. আব্দুল মোন্নাফ বলেন, ‘চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এখনও কিছু কিছু হাওরে ধান রোপনের কাজ চলছে। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করা না যায় তাহলে গোটা জেলার বোরো ফসল আগাম বন্যার হুমকিতে পড়বে।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন, ‘হাওরে বাঁধ নির্মাণের কাজ দেরিতে শুরু হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। কারণ এবছর কাজের পারিমাণ কম। পিআইসিগুলো (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) আন্তরিকভাবে কাজ করলে ২৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যেই ফসর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হবে।’ খনন যন্ত্র সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশে যথেষ্ট উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হচ্ছে। এস্কেভেটর মেশিনের কোনও অভাব নেই।’ হাওরের বাঁধে মাটি সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এবছর হাওরের বাঁধে মাটি পরিবহনের জন্য ড্রাম ট্রাক এস্টিমেটের সঙ্গে ধরে দেওয়া হয়েছে। তাই দূরের এলাকা থেকে মাটি এনে বাঁধ নির্মাণ করতে পিআইসিদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে তিনি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে যেকোনও ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। কোথাও কোন অভিযোগ পেলে পাউবো নিজে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এজন্য সবার আন্তরিক সহযোগিতা চাই।’