‘ঢাকার উপরেদি পানির অভাব লাগছে আমরার সুনামগঞ্জ’

দুই-তিন হাটির মানসে পানি নেইন আইয়া, ই পানি না অইলেতো আমরা মরলাম অনে। পানি দেওয়ায় আমরার জান বাঁচছে। পোয়ায় এগু কল দিছইন, অতারদায় লাইন বান্দিয়া নিরা পানি। আমরা নিয়া তুলিয়া তুলিয়া থুই পানি। ঢাকার উপরেদি পানির অভাব লাগছে আমরার সুনামগঞ্জ।  (দুই তিন গ্রামের মানুষ পানি নেন, এই পানি না হলে আমরা মরে যেতাম। পানি পাওয়াতে জীবন বেঁচে গেছে। এই বাড়ির ছেলে একটা কল বসাইছে, তাই সবাই লাইন ধরে পানি নিচ্ছে। আমরা পানি জমিয়ে রাখি। ঢাকার চেয়ে বেশি পানির অভাব আমাদের সুনামগঞ্জে।)

5

বুধবার বিকেলে এভাবেই সুনামগঞ্জ শহরের উত্তর আরপিন এলাকার নেহারুন্নেছা বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা বলছিলেন।  প্রতিবেশী হায়ারুনের বাড়িতে এলাকাবাসীর পানি অভাব মেটাতো বসত ঘর ভেঙ্গে গভীর নলকূপ বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরে বাড়ির সীমানা প্রাচীর ভেঙে আশপাশের শতাধিক পরিবারকে পানি দিয়ে যাচ্ছেন। নেহারুন্নেছাও পানি নিচ্ছেন এখান থেকে।

নেহারুন্নেছা বলে চলেন, কোনও খানও আমরা পানি পাই না। আগে দুই হাটি তিন হাটি মারিয়া গিয়া পানি আনতাম। তারা পানি দেওয়ায় আমরা অত দুরই তাকি পানি আনি না। ই কান্দাত চাপ কল নাই। সাপ্লাইর পানিও নাই। এ সময় পাশে থাকা অপর একজন গৃহিনী সায় দিয়ে বলেন, আমরা তো সব সময় পানি পাই না।

হাওর বেস্টিত সুনামগঞ্জের মিঠা পানির কোন অভাব না থাকলেও পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন হাওরবাসী ও সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার নাগরিকরা। পবিত্র রমজান মাসের শুরুতে বিশুদ্ধ পানীর এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পৌর এলাকার  উত্তর আরপিননগর, ষোলঘর, বড়পাড়া, হাজীপাড়া, মরাটিলা, নবীনগর, নুতনপাড়া, জামাইপাড়া, কালীবাড়ি, তেঘরিয়া ও মধ্যশহরে পানির সংকট রোজদার মানুষকে মারাত্মক দুর্ভোগে ফেলেছে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকার স্থাপিত টিউবওয়েল থেকে পানি না ওঠায় সংকট আরও তীব্র হয়েছে। মানুষ নিরুপায় হয়ে গৃহস্থলীর কাজে নদী, ডোবা ও হাওরের পানি ব্যবহার করছেন। শহরের উত্তর আরপিননগর এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে এক বেলা বিনামূল্যে পানি বিতরণ করা হচ্ছে। এ পানি ব্যবহার করে সেহরি ও ইফতার সামগ্রী তৈরিসহ নিত্য প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করছেন।

6

সুনামগঞ্জ শহরে ৮৭ হাজার নাগরিকের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য পৌর এলাকার ৯ টি ওয়ার্ডে ৬১৮ টি হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অকেজো ২৫০টি। এছাড়া একটি সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে ২৮ কিলোমিটার পানির লাইন দিয়ে ১ হাজার ৬০১ জন গ্রাহককে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা মোট জনসংখ্যার ২৫ ভাগ, বাকী ৭৫ ভাগ নাগরিক পৌরসভার পানীয় জলের সুবিধার বাইরে রয়েছেন। 

জেলা জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর জানায়, মোট ২৭ লাখ জনসংখ্যার জন্য সরকারি-বেসরকারি  মিলিয়ে ৪৫ হাজার ১৩৭টি অগভীর ও গভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপের মধ্য ৬৩৫ টি নলকুপ অকেজো হয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্ধের অভাবে পৌর কর্তৃপক্ষ শহরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না।

শহরের নুতনপাড়া এলাকার বাসিন্দা মৃদুল কান্তি দাস বলেন, শহরে ফালগুন-চৈত্র মাসে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি কোনও টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। সরকার যদি কিছু সাবমার্জিবল টিউবওয়েল স্থাপন করে দিতো তাহলে সংকট নিরসন হতো।

পূর্ব-নুতনপাড়া এলাকার বাসিন্দা রমেশ দাস বলেন, সাধারণ টিউবওয়েল যেগুলো আছে সেগুলো দিয়ে পানি ওঠে না। এ পাড়ায় তিনটি টিউবওয়েলের মধ্যে তিনটি অকেজো হয়ে পড়েছে আছে। সমস্যা নিরসনে পৌর কর্তৃপক্ষ যদি ব্যবস্থা না করে তাহলে বিশুদ্ধ পানির সংকট লেগে থাকবে সবসময়। দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করবে।

4

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত সংকট সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বলেন, পৌরসভার নিজস্ব অর্থায়নে ৯টি ওয়ার্ডে  টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ চলছে। এগুলো স্থাপন করা হলে সংকট কিছুটা নিরসন হবে।  

জাকির আহমদ নামের ব্যক্তি বলেন, ধনীদের কোনও সমস্যা নাই, সব সমস্যা গরিবের। ধনীদের টিউবওয়েল তো আমরা ব্যবহার করতে পারি না। আমরা গরিবরা ডোবায় গোসল করি, কাপড় ধোয়াসহ সবকাজ করি। 

পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মীর মোশারফ হোসেন বলেন, নুতন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু হলে অর্ধেক নাগরিককে সুপেয় পানীর সেবা দেওয়া যাবে। 

জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, হাওর এলাকার পানীয় জলের সংকট নিরসনের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সংকট কিছুটা হলেও কমবে। জেলায় গড়ে ৬০ জন লোকের বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য একটি নলকূপ রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে ২১ হাজার ৯৯২ টি নলকূপ রয়েছে।