৫ দিন ধরে পানিবন্দি সুনামগঞ্জের মানুষ, ত্রাণ পায়নি অনেক পরিবার

পাঁচ দিন ধরে বন্যার পানিতে ঘরছাড়া সুনামগঞ্জ পৌরসভার কালীপুর গ্রামের রিকশাচালক আলী হোসেন ও আকলিমা খাতুন দম্পতি। বসতঘরে কোমর পর্যন্ত পানি। ঝাউয়ার হাওরের পানিতে ডুবে আছে পুরো গ্রাম। গবাদিপশু রেখে এসেছেন উঁচু জায়গায়। দুই মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে উঠেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। পাঁচ দিনেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি ত্রাণ সহায়তা। এসব অভিযোগ করেছেন আলী হোসেন ও আকলিমা খাতুন।

একই গ্রামের দিনমজুর দম্পতি শিল্পী বেগম ও লিটন মিয়া বলেন, ‌‌ঘরে-বাইরে পানি খেলা করছে। রাস্তাঘাট ডুবে আছে। অন্যের বাড়িতে বসবাস করছি। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনও ত্রাণ সহায়তা পাইনি আমরা।

একই গ্রামের পলেহা খাতুনের ঘরে গিয়ে দেখা গেছে, টিনের বাক্সে বিকল্প চুলা তৈরি করে কোনও রকমে ভাত রান্না করছেন তিনি। বসতঘরের বাঁশের মাচায় ছাগলকে রেখে কাঁঠালপাতা দিচ্ছেন। ঘরে হাঁটুপানি। 

তিনি বলেন, ‘অনেক আগেই আমার স্বামী মারা গেছেন। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলে মনিরুল ইসলাম ও পুত্রবধূ আমেনা খাতুন এবং দুই নাতি নিয়ে পানিবন্দি অবস্থায় আছি। ছেলের কাজকর্ম বন্ধ। এতদিন রিকশা চালিয়ে সংসার চালিয়েছে। এখন সড়ক ও বাড়িঘরে পানি। বের হতে পারছে না। কোনও রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। রান্নার জ্বালানি কাঠ নেই। ভয়াবহ দুর্ভোগে আছি আমরা।’ 

ঝাউয়ার হাওরের পানিতে ডুবে আছে পুরো গ্রাম

কালীপুর গ্রামের ছাজ মিয়ার কলোনির বাসিন্দা ছাজ মিয়া বলেন, আমার কলোনিতে এনামুল হক, দবির সুমন, আরমান হোসেন, আব্দুর রহমান, চাঁন মিয়া ও জোবেদা খাতুনসহ ১৫ দিনমজুর পরিবার বাস করে। তাদের মধ্যে সাত পরিবারের বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অন্যত্র চলে গেছে। এখানের বাসিন্দারা ত্রাণ পায়নি।

কলোনির বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, ‘বসত ও রান্নাঘর, টিউবওয়েল সব ডুবে গেছে। পানি আরও বাড়লে ঘরও ডুবে যাবে। পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দি। একমুঠো চাল দিয়ে কেউ সহযোগিতা করেনি। কত কষ্টে আছি, নিজেরাই জানি।’

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘বন্যার্তদের মধ্যে যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত অপ্রতুল। ত্রাণের বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার। শ্রমজীবীদের বেশি করে ত্রাণ দিতে হবে। যাদের ঘর নষ্ট হয়েছে, তাদের সরকারি টিন দিতে হবে। দরিদ্র বন্যাদুর্গতদের ঘরে ঘরে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে।’

সুনামগঞ্জ পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, শনিবার পর্যন্ত সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ৪০, মল্লিকপুর বিসিক শিল্প এলাকায় পাঁচ, ষোলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চার এবং মল্লিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া শহরের ওয়েজখালী, কালিপুর, জলিলপুর, পাঠানবাড়ি, হাছনবসত ও গণিপুর শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার নিম্নাঞ্চলে শতশত মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তাদের অনেক পরিবার ত্রাণ পায়নি।

নৌকা দিয়ে চলাচল করছেন গ্রামের বাসিন্দারা

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, ‘শনিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শহরের বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরে মানুষের খোঁজখবর নিয়েছি। আমার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের প্রত্যেক পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল ও নগদ ২০০ টাকা করে সহযোগিতা করেছি। রবিবার থেকে সরকারি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হবে। পৌর এলাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পাঁচ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। তবে গ্রাম বা পাড়াভিত্তিক ত্রাণ বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়নি।’

ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুনুর রহমান বলেন, ‘ছাতক উপজেলায় চার হাজার পরিবারকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল ও শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত ৪০ টন চাল, ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, নগদ দুই লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলার উত্তর অংশের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দক্ষিণ অংশে পানি বেড়ে নতুন কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের সমন্বয়ে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের নামের তালিকা তারাই করেছেন। এরপরও যদি কেউ ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেন, তাহলে উপজেলা প্রশাসন সরাসরি তাদের ত্রাণ দেবে।’

টিনের বাক্সে বিকল্প চুলা তৈরি করে কোনও রকমে ভাত রান্না করছেন পহেলা খাতুন

দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাংশু কুমার সিংহ বলেন, ‘উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। দুই ফুট পানি কমেছে। কিন্তু হাওর এলাকায় এখনও অনেক মানুষ পানিবন্দি। ছয় হাজার পরিবারের মধ্যে চাল, শুকনা খাবার ও প্রধানমন্ত্রীর উপহার বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলার নয় ইউনিয়নের মানুষ বন্যাদুর্গত। এর মধ্যে দোয়ারাবাজার ও সুরমা ইউনিয়নের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দ্রুত পানি নেমে গেলে দ্রুত উন্নতি হবে।’

আবহাওয়া অধিদফতর সিলেটের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘শনিবার ও রবিবার রাতে বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে দিনের বেলায় হবে না। আগামী ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬ মে বৃষ্টিপাত কমে যাবে।’ 

তিনি বলেন, ‘চলতি বছর মে মাসে সিলেটে ৫৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে ৭০০ মিলিমিটার। তবে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে। একই সঙ্গে যেসব স্থানে পানি উঠেছে তা নেমে যাবে।’

ভয়াবহ দুর্ভোগে আছে সুনামগঞ্জের মানুষ

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহরুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি পুরোপুরি সরে যেতে সাত দিন সময় লাগবে। রবিবার থেকে দ্রুত পানি কমবে।’

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘জেলায় ১৬৫ মেট্রিক টন চাল, ১২ লাখ টাকা, শুকনা খাবার ও মোমবাতি বিতরণ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দুপুরে খিচুড়ি, সকালে কলা-রুটি দেওয়া হচ্ছে। রবিবার থেকে পৌরসভার নিম্নাঞ্চলে ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।’ 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাতক, দোয়ারাবাজার, সদর, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার ৫০ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি। কয়েকটি পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। অধিকাংশ পরিবার ত্রাণ পায়নি।