সুনামগঞ্জে খাবার সংকট, উচ্চদামে পণ্য বিক্রি

বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যার কারণে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন সুনামগঞ্জবাসী। দ্বিতীয় দফা বন্যার ক্ষতির মধ্যে তৃতীয় দফায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন জেলার আট উপজেলার লাখ লাখ মানুষ। এসব উপজেলার জলার ৮০ থেকে ৯০ ভাগ এলাকা কয়েকদিন ধরে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষ ত্রাণ, শুকনো খাবার, মোমবাতি ও পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেটের জন্য হাহাকার করছেন। জেলায় সরকারি-বেসরকারি ছয় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) বিকাল থেকে জেলার সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জসহ সবকটি উপজেলার মানুষ পানি বন্দি হয়ে অসহায় দিন যাপন করছেন। গবাদি পশু ও মানুষের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

বানভাসি মানুষদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ যৌথবাহিনী। প্রতিটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন। বন্যার কারণে জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সোমবার (২০ জুন) বিকালে সুনামগঞ্জ শহরের বাজার এলাকায় সীমিত আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবার ও ত্রাণ বিতরণ করছেন সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন।

এদিকে, সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরের শতভাগ এলাকা এখনও পানিতে ডুবে আছে। সড়কে আড়াই থেকে তিন ফুট পানি থাকায় লোকজন নৌকায় চড়ে সীমিত পরিসরে যাতায়াত করছেন। বন্যার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ ও তিনগুণ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। ছয়টি মোমবাতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। তেল, চিনি, লবণ, বিস্কুটসহ সব শুকনো খাবার উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছে দোকানদার ও হকার। দুর্গত এলাকার অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, মন্দির, মসজিদ, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সব কিছু পানিতে তলিয়ে আছে। ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও শুকনো নেই। এদিকে চড়া মূল্যে নৌযান দিয়ে লোকজনকে পারাপার করছেন এক শ্রেণির জেলের নৌকার মালিকরা।

বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে সব কিছুর সংকট দেখা দিয়েছে। মোমবাতি, দিয়াশলাই, চাল, ডাল, চিনি সব কিছু উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। শহরের পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, ভোজ্যতেল, বিশুদ্ধ পানিসহ সব কিছুর সংকট দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণে মানুষ বৃষ্টির পানি ও বানের পানি ব্যবহার করছেন।

সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরের সব ভবনের নিচতলা পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় আসবাবপত্র, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীসহ মূল্যবান জিনিসপত্র পানিতে ডুবে আছে।

জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বানভাসি মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। দিনরাত বিভিন্ন এলাকায় ডিউটি করছে। এখন পর্যন্ত কোনও চুরি ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। বন্যার্ত মানুষের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ তৎপর রয়েছে।’

জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বানভাসি মানুষের পাশে রয়েছে প্রশাসন ও সরকারসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকায় খিচুড়ি, শুকনো খাবার চালসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। জেলা সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখ ৬০ হাজার নারী-পুরুষ শিশু আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গতদের মধ্যে ৮০ মেট্রিক টন জিআর চাল, নগদ ৮০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বোতলজাত পানি দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী,নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের বিপুল সংখ্যক সদস্য বানভাসি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন তারা। দুর্গতদের মধ্যে শুকনো খাবার চিড়া-মুড়ি, গুড়, পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট, রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সরকার দুর্গত মানুষের পাশে সবসময় রয়েছে।

সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, সুনামগঞ্জের ইতিহাসে এটি ভয়াবহ বন্যা। মানুষ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছেন। বন্যার কারণে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় জেলা শহর থেকে উপজেলাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। এখন পর্যন্ত পানি নামার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে, ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত রয়েছে। সবমিলিয়ে সুনামগঞ্জবাসী একটি মহাদুর্যোগে পতিত হয়েছেন।