এক জেলাতেই বছরের পর বছর পতিত কয়েক হাজার হেক্টর জমি

দেশের খাদ্য চাহিদা মোকাবিলায় করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জমি অনাবাদি না রাখার নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। এমনকি বাড়ির আশপাশে পতিত জমিতেও সবজির চাষের আহ্বান জানিয়ে আসছেন তিনি। অথচ মৌলভীবাজার জেলায় কয়েক হাজার হেক্টর অনাবাদি জমি পড়ে আছে বছরের পর বছর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলাটিতে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ আরও দিন দিন কমছে। বিশেষ করে যততত্র অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পায়নের কারণে কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। আবাদযোগ্য যতো জমি আছে, তার পুরোটা আবাদের আওতায় আসছে না। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে শিগগিরই অনাবাদি জমিগুলো চাষের আওতায় আনা হবে।

মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জেলার আয়তন ২ হাজার ৭৯৯ দশমিক ৪০ বর্গ কিলোমিটার। জেলার মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ ২৩ হাজার ৪৪৫ জন। এই জেলায় সাতটি উপজেলায় ৬৭টি ইউনিয়ন ও পাঁচটি পৌরসভা রয়েছে। ৮৯৯টি মৌজার ২ হাজার ১৫টি গ্রাম আর কৃষি ব্লকের সংখ্যা ২০৫টি। নিট ফসলি জমি ১ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর ৯৯৫, এক ফসলি জমি ৪৩ হাজার ১৯৭ হেক্টর, দুই ফসলি জমি ৬২ হাজার ২৯৪ হেক্টর, আর তিন ফসলি জমি ২২ হাজার ৫০৪ হেক্টর। সব মিলিয়ে মোট ফসলি জমি ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৭ হেক্টর। এই জেলার জমিতে শস্যের নিবিড়তা ১৯৪ শতাংশ। রবি শস্য (মৌসুম ভিত্তিক) উৎপাদন হয় ৪৬ হাজার ৭৯২ হেক্টর জমিতে, খরিপ-১ (মৌসুম ভিত্তিক) চাষ হয় ৭৯ হাজার ৬৭৫ হেক্টর এবং খরিপ-২ (মৌসুম ভিত্তিক) চাষ হয় ২৬ হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে।

আর জেলায় স্থায়ী পতিত জমি ১০ হাজার ৬৯০ হেক্টর। এছাড়াও জলাভূমি ২০ হাজার ৪৬২ হেক্টর ও বনভূমি ৩০ হাজার ৬৬৫ হেক্টর। মোট আবাদযোগ্য ১ লাখ ৪১ হাজার ১০০ হেক্টর। মোট কৃষক ২ লাখ ৬০ হাজার ৯০৭ জন। জেলায় চা বাগানের সংখ্যা ৯২টি। চা বাগানের আওতাধীন জমির পরিমাণ ৬৩ হাজার ১৭৬ হেক্টর। জেলায় ছয়টি হাওরের আয়তন ৪৭ হাজার ৭২৫ হেক্টর। হাওরে চাষের অধীন জমি ২৭ হাজার ৯০০ হেক্টর। জেলায় খাদ্য শস্যের চাহিদা রয়েছে ৪ লাখ ১৮ হাজার ৭৮১ মেট্রিকটন। খাদ্য শস্য উৎপাদন হয় পরিমাণ ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৫৪ মেট্রিকটন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, জেলায় ৬ লাখ ৯২ হাজার একর জমি থাকলেও আবাদের বাইরে আছে ৩১ হাজার একর জমি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, মৌলভীবাজার জেলায় প্রবাসীদের সংখ্যা বেশি। তাদের মালিকানাধীন জমি বেশিরভাগই অনাবাদি থেকে যায়। দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রবাসীরা নিজেদের জমি অন্য কাউকে চাষাবাদের জন্য দিতে অনিচ্ছুক। এ ছাড়া হাওরের বিপুল পরিমাণ জমি পানিতে তলিয়ে থাকে বলে চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। আবার সীমান্তবর্তী এলাকায় বর্ষা মৌসুমে ঢলের সাথে বালি, পাথর এসে জমির ক্ষতি হয়; ফলে এসব জমিতে চাষাবাদে অনাগ্রহী কৃষকরা। আবার বন্যাও বিপুল জমি অনাবাদি থাকার একটি কারণ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. সামছুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আবাদযোগ্য কিন্তু চাষ হচ্ছে না, এমন নয়। তবে যেগুলো জমি পতিত পড়ে আছে সেগুলোতে চাষাবাদ করে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো হবে। এজন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখানকার যারা জমির মালিক তারা অনেকেই বিদেশে থাকেন। তারা জমি নিজেরা চাষ করতে চান না। অন্য কাউকে দিয়েও চাষ করাতে চান না। তারা মনে করেন, মালিকানা নিয়ে পরে ঝামেলা হতে পারে।’

সমতল ভূমি ছাড়াও পাহাড়ি ভূমি বেশি হওয়ায় কিছু পাহাড়ি স্থানে লেবু, কমলা, আনারসসহ বিভিন্ন ফলের চাষ করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তবে এর বাইরেও বড় একটি অংশ আবাদের বাইরে থেকে যাচ্ছে।’

মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো.হায়দার হোসেন বলেন, পতিত জমিতে চাষাবাদ করতে গেলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে, স্বল্প সেচে যেসব ফসল উৎপাদন হয় সেগুলোর আবাদ আরও বাড়াতে হবে। এখানে জেলা আলু চাষ বেশি হয়, এই ফসলের আবাদ আরও বাড়াতে হবে।’

সরকারের নতুন কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ এই অঞ্চলেরই জনপ্রতিনিধি (শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ)। তিনিও বলেছেন, ‘আমি নিজেই মাছ, ফল ও শাকসবজি চাষ করি। দেশের কৃষি খাতকে ঢেলে সাজাতে আন্তরিকভাবে কাজ করবো। মন্ত্রণালয়ের চলমান কাজ এবং আগের কাজগুলো তদারকি করে দেখবো। কোথাও কোনও সংকট থাকলে সমাধানের চেষ্টা করবো। মাঠপর্যায়ে ও বিভিন্ন দফতরে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম কেমন চলছে, তা জানাবো। সবার সহায়তায় কৃষিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।’