পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সংস্কারে সুফল দেখছেন শিক্ষাবিদরা

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে এসএসসি পরীক্ষার ফলের পর উল্লাসএবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল গতবারের চেয়ে খারাপ হয়েছে। পাসের হার যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, বহু বছর ধরে পরীক্ষা পদ্ধতি ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি সংস্কারের যে দাবি তোলা হচ্ছিল, এখন তার সুফলটাই হয়তো পাওয়া যাচ্ছে। পাসের হার কম হওয়ার পেছনে প্রশ্নফাঁস না হওয়াসহ কয়েকটি ইতিবাচক দিকের কথাও উল্লেখ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। 

বৃস্পতিবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশ করা হয়। জানা গেছে, এবার পাসের হার ৮০.৩৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে পাসের হার ছিল ৮৮.২৩ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন। ২০১৬ সালে জিপিএ-৫ পায় ছিল  ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন।

পাসের হার কম হওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ড. রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরেই বলে আসছি, পরীক্ষা পদ্ধতি ও উত্তপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। আর এই পরিবর্তনটি সময়ের দাবি। কারণ, দেশে যেভাবে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা হতো, তাতে করে শিক্ষার মান গতানুগতিক হয়েছে। পরীক্ষার খাতা ঠিকমত না দেখেই নম্বর দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল।’ সেখান থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

কি কি ধরনের সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, এবার শিক্ষকদের খাতা দেখার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কীভাবে খাতা দেখবে, নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম ফলো করা হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তো উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কারের কথা বলেছি বহুবার। কারণ, আমরা দেখেছি, শিক্ষকরা খাতায় বেশি বেশি নম্বর দিয়ে রাখতো। যখনই সেই একই খাতা অন্য শিক্ষককে দিয়ে দেখানো হতো, তখন দুই শিক্ষকের দেওয়া নম্বরের মধ্যে চমকে উঠার মতো পার্থক্য পাওয়া যেত। এসব কারণে আমরা বলেছি, খাতা মূল্যায়নে অনেক পরিবর্তন দরকার। মানদণ্ড ধরে খাতা মূল্যায়ন করা হোক। তারই কিছু কিছু বিষয় আমলে নিয়ে এবার খাতা মূল্যায়ন করা হয়েছে।’ সামনে শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও ভালো কিছু আসবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেনি তিনি।

মানদণ্ড ঠিক রেখে এগিয়ে গেলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নটা ঠিকঠাকভাবে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার মান ঠিক থাকলে সেই শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়ে, তেমনি শিক্ষার্থীদের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে। শিক্ষার্থীরাও নিজেদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারবে। এতে তাদের এগিয়ে যাওয়াটা আরও সুপ্রসন্ন হবে।’

এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সচিবালয়ে ফল প্রকাশের সভায় বলেন, ‘এ বছর ফলাফল বিপর্যয়ের ছোটখাটো অনেক কারণ আছে। তবে এর মূল কারণ নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন। প্রশ্নফাঁস রোধ ও পরীক্ষাকেন্দ্রে কড়াকড়ির কারণেও আগের বছরের চেয়ে কম পাস করেছে। তবে ফলাফল বিপর্যয় মনে হলেও আসলে বিপর্যয় নয়, এ বছর সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।’

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এবার উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়েছে বলেই পাসের হার কম, এই বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘উত্তরপত্রের মূল্যায়ন যদি এখন ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বিগত বছরগুলোতে কি ঠিক ছিলনা?’

বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রী কি এখন স্বীকার করবেন, বিগত বছরগুলোতে বেশি বেশি নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাস করানো হয়েছে, জিপিএ-৫ দেওয়া হয়েছে। এই যুক্তিতে বলা যেতে পারে, আগের বছরগুলোতে শিক্ষামন্ত্রী ফলাফল নিয়ে যে পরিমাণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তা ঠিক ছিলনা।’

বিভিন্ন সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস, খাতায় বেশি বেশি নম্বর দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ছিল উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘প্রতি বছরই প্রতিটা পরীক্ষার সময় আমরা দেখি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। শিক্ষকরা খাতায় বেশি বেশি নম্বর দেন। এছাড়া গাইডবই থেকে প্রশ্ন তুলে দেওয়ার অভিযোগও আছে। সরকার এখন পাসের হার বাড়াতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আর এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আরও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। তাদের এখনই হুঁশ করা উচিত। না হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার করুণ অবস্থা দেখতে হবে।’

/আরএআর/এসএ/