‘মব’ সৃষ্টি করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নুরুল হুদাকে জুতার মালা পড়িয়ে তার সঙ্গে অসদাচরণ করে পুলিশে দেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিশিষ্টজনরা নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে। নুরুল হুদার সঙ্গে অসদাচরণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। মবের ঘটনায় উঠে আসে এসেছে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের বেশকিছু নেতাকর্মী নাম। এরমধ্যে ভিডিওতে নুরুল হুদাকে যিনি জুতা দিয়ে মারছিলেন তাকে আটক করেছে পুলিশ।
রবিবার (২২ জুন) সন্ধ্যায় কিছু লোক উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে সাবেক সিইসি নুরুল হুদার বাসা ঘেরাও করে মব সৃষ্টি করে। পরে বাসা থেকে নামিয়ে এনে তার সঙ্গে অসদাচরণ করা হয়। এসময় এ ঘটনায় ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ জানায়, খবর পেয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উত্তরা পাঁচ নম্বর সেক্টরের বাসার সামনে থেকে তাকে আটক করে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ।
এরআগে রবিবার দুপুরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় সাবেক তিনজন সিইসিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বিএনপি। সেই তালিকায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি নুরুল হুদার নামও ছিল। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল রবিবার থানায় ওই মামলার অভিযোগপত্র দেন।
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার বাসা ঘেরাও করে মব সৃষ্টির সময় ধারণ করা ভিডিওতে অনেককেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নামে বিভিন্ন স্লোগান দিতেও শোনা যায়। ভিডিও বিশ্লেষণ করে সেখানে থাকা কয়েকজনের নামের তালিকা পেয়েছে বাংলা ট্রিবিউন। এরমধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসকে ফরিদ হোসাইন, সদস্য মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ঢালী, দুলাল, উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক হানিফ মিয়া, উত্তরা পূর্ব থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক কাইয়ুম এবং তুরাগ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক জামান ছিলেন। ভিডিওতে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢালী নুরুল হুদাকে জুতা পেটা করছেন। যদিও এসব ভিডিও প্রযুক্তির সহায়তায় এআই দিয়ে করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসকে ফরিদ হোসাইন।
ফরিদ হোসাইন ঘটনাস্থলে ছিলেন না দাবি করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘নুরুল হুদা ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তিনি বিগত সরকারের সময় অনেক অন্যায় করেছেন। তবে নুরুল হুদাকে ঘিরে মব সৃষ্টির ঘটনায় আমাদের কোনও নেতা-কর্মী সেখানে ছিল না। যেসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলো এআই দিয়ে করা। প্রযুক্তির সহায়তায় আমাদের নেতাকর্মীদের সংযুক্ত করা হয়েছে।’
এদিকে বিএনপি ‘মব’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বলে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, “আমরা মব কালচার বিশ্বাস করি না। কারও প্রতি এই ধরনের অপমানজনক আচরণ আমরা মেনে নেবো না। আমরা আইনের শাসনের জন্য লড়াই করি, সমবেত সহিংসতার সংস্কৃতি নয়।”
তিনি আরও বলেন, যদি বিএনপির কোনও নেতাকর্মী এই ঘটনায় জড়িত থাকে, তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন (শৃঙ্খলাবিরোধী ব্যবস্থা) আমরা নেবো, এটা আমাদের অবস্থান।
একই মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তারা জানিয়েছেন, নুরুল হুদার সঙ্গে মব সৃষ্টি করে অসদাচরণ করার ঘটনায় বিএনপির যারাই জড়িত থাকবে, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মব সৃষ্টির ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে আটকের সময় যেভাবে মব জাস্টিস করা হয়েছে তা কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনায় বাহিনীর কেউ জড়িত থাকলে তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে মব সৃষ্টির ঘটনায় সোমবার রাতে উত্তরা এলাকা থেকে উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক হানিফ মিয়াকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ফরিদসহ আরও অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। মব সৃষ্টিকারী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ ব্যাপারে একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানিয়েন ওসি হাফিজুর রহমান।
এদিকে এ ঘটনায় নিন্দা ও মব সৃষ্টির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অনুচিত। বিচার আদালতের বিষয়। যারা মব তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সরকার সকল নাগরিককে শান্তিপূর্ণ সহনশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সকলের সহযোগিতা কামনা করেছে।
এছাড়াও এ ঘটনায় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
