বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি,  কী থাকতে পারে নীতিমালায়?

অবশেষে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) ও মাস্টার অব ফিলোসফি (এমফিল) ডিগ্রি প্রদানের সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এ জন্য শিগগিরই একটি নীতিমালা করবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। নীতিমালা প্রণয়ন করতে সম্প্রতি ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কী থাকছে নীতিমালায় তা নিয়ে চলছে আলোচনা, অপেক্ষায় আছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

ইউজিসি’র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দকে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক হাসিনা খান, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন ও বর্তমানে উত্তরা ইউনিভার্সিটির সহ–উপাচার্য অধ্যাপক গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) সাবেক পরিচালক ও গ্রিন ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ, ইউজিসির পরিচালক ওমর ফারুখ।

কমিটির কর্মপরিধিতে বলা হয়, কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য কো-অপ্ট (অন্তর্ভুক্ত) করতে পারবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন ও ক্লাস্টারের উপযোগী পিএইচডি কোর্সওয়ার্ক/রিসার্চ মেথডলজি সংক্রান্ত কারিকুলাম/মডিউল প্রণয়ন করতে পারবে কমিটি।

জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘নীতিমালা প্রণয়ন করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। নীতিমালার খসড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণয়ন করা হবে।’

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, নীতিমালায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নির্ধারণে একটি মানদণ্ড (ক্রাইটেরিয়া) থাকবে। মানদণ্ড অনুযায়ী যোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর অনুমোদন পাবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ যোগ্যতার মাপকাঠির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নবায়ন থাকতে হবে। পিএইচডি গবেষণার জন্য অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। প্রোগ্রাম চালু করতে হলে ডিসিপ্লিন অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক থাকতে হবে। পিএইচডি গবেষণার ক্ষেত্রে অন্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-সুপারভাইজার মনোনয়ন দিতে হবে।

পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর অনুমতি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওই ডিগ্রি যেন যেমন-তেমনভাবে না করায় সে জন্য একটি বিশেষ নির্দেশিকা থাকবে নীতিমালায়। বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দেওয়া হবে পিএইচডি করানোর জন্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় দেশি ও বিদেশি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি কেনা-বেচার অভিযোগ রয়েছে। সে কারণে নীতিমালায় কিছু বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হবে। আবার থিসিস নকল করে বা গবেষণা চুরি করে বা কপি করে ডিগ্রি নেওয়ার অভিযোগ যেন না উঠে- সেটি নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা রাখা হবে নীতিমালায়।

পার্টটাইম হিসেবে ডিগ্রি নিতে পারবেন গবেষকরা। এতে সময় দেওয়া হতে পারে সাত বছর পর্যন্ত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির (এপিইউবি) চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতির ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাতে বৈষম্য না হয় সেই বিষয়টিই আমাদের চাওয়া।’

নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ইউজিসি নিয়ন্ত্রণ করে, তারা কী নিয়ম-কানুন করবে, আমরা এখনও জানি না। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আমাদের তো ভিন্ন হবেই। কারণ এখানে যারা পড়তে আসে তারা তো টাকা-পয়সা দিয়ে পড়তে আসে। পিএইচডির মানের (কোয়ালিটি) দিকে আমাদের অনেক সজাগ থাকতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির মান না থাকলে কেউ পিএইচডি করতে আসবে না। আমি মনে করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এক্ষেত্রে নিজের স্বার্থেই ভালো ও সক্ষম শিক্ষার্থী গ্রহণ করতে হবে। এখান থেকে ভালো ও মানসম্পন্ন পিএইচডি ডিগ্রি করা শিক্ষার্থীকে বাজারে ছাড়তে হবে, যাতে করে বোঝে যে ওরা অন্য কারও পিএইচডির চেয়ে ভিন্ন।’

‘শুধু নিয়ম দিয়ে তো ভালো পিএইচডি হয় না। মিনিমাম কোয়ালিটি নিশ্চিত করা যায় কিন্তু বেস্ট কোয়ালিটি প্রতিষ্ঠানের এক্সিলেন্সির ওপর নির্ভর করে। যদি টপ কোয়ালিটির শিক্ষার্থী পাই, টপ কোয়ালিটির সুপারভাইজার থাকে। যদি ভালো এক্সেস টু লিটারেচার থাকে, যদি এরকম শিক্ষক থাকে যারা মেথডলজি সম্পর্কে খুবই সচেতন। এক্সপার্টিজ গড়ে তুলতে হবে। যাতে সেগুলো ‘গরু রচনা’ না হয়ে যায়। কেউ যেন কমার্শিয়ালি পিএইচডি প্রডিউস না করে- সেটি নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমার কথা হলো- মানসম্পন্ন পিএইচডি যেন আমরা নিশ্চিত করতে পারি।’

গবেষণার ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীন করে দিলে ভালো পিএইচডি হবে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, স্বাধীন না করলে সুপারভাইস করবে কীভাবে? যেটা তারা করতে পারে— পিএইচডি অন্তর্ভুক্তির যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে পারে, থিসিসের ধরনটা বলে দিতে পারে। যে সুপারভাইস করবে তার কী যোগ্যতা থাকবে, কী ডিগ্রি ও পাবলিকেশন থাকতে হবে— এগুলো ইউজিসি বলে দিতে পারে। কিন্তু এক্সিলেন্ট কোয়ালিটি আলাদাভাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করবে। সুপারভাইজার ও শিক্ষার্থীর মানের ওপর নির্ভর করবে। সুপারভাইজার যেন কম্প্রোমাইজ না করেন- সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নীতিমালায় বলে দিতে পারে— কোনও সুপারভাইজারের কমপক্ষে ৭টি থেকে ১০টি আর্টিকেল যদি জার্নালে ছাপা না থাকে তিনি সুপারভাইস করতে পারবেন না। যদি বাধ্যতামূলক করে দেয় যে, একজন প্রিন্সিপ্যাল সুপারভাইজারের সঙ্গে আরও দুই জন অ্যাসোসিয়েট থাকবে এবং তাদের কোয়ালিটি যদি ইউজিসি নির্ধারণ করে দেয় তাহলে একজন লোক যা ইচ্ছা তা করতে পারবে না। তখন কোয়ালিটি নিশ্চিত হবে। কমিটি একটা ভালো গাইডলাইন তৈরি করবে— আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-ইউল্যাব উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, ‘মানদণ্ড অনুযায়ী যারা যোগ্য তারা প্রোগ্রাম চালুর অনুমোদন পাবে। কেউ পাবে, কেউ পাবে না— তেমনটি হওয়া উচিত নয়। আমরা পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি। আমাদের সে সক্ষমতাও আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করার সুযোগ পাবে যদি অনুমতি দেওয়া হয়।’

ইউজিসি সূত্র জানায়, কমিটি গঠনের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করা হবে। খসড়া বিধিমালা চূড়ান্ত হলে ইউজিসির পূর্ণ কমিশনে অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। তবে পূর্ণ কমিশনে অনুমোদনের জন্য একাধিক বিষয় উত্থাপন করা হয়, এজন্য সেখানে অনুমোদন পেতে সময় লাগে।

এদিকে, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালুর অনুমতি পাবে না এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অন্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে করে ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা নিতে পারে— সেরকম ব্যবস্থা নেবে ইউজিসি।

প্রসঙ্গত, দেশে এখন অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৪। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতি পাবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে যারা মান অর্জন করতে পারবে তারা পরে পিএইচডির অনুমতি পাবে।