এফটিপিও: আন্দোলন শেষ নাকি স্থগিত!

এফটিপিও: ভাবনার গভীরে মাসুম আজিজসময়টা গত বছরের নভেম্বর মাস। বাংলাদেশের টিভি মাধ্যমের জন্য ঐতিহাসিক একটি সময় বলা চলে। কারণ এ মাসে বাংলাদেশের টিভি সংশ্লিষ্ট সব শিল্পী-কলাকুশলীরা মাঠে নেমেছিলেন ৫ দফা দাবিতে। পরবর্তীতে আরও ৮ দফা যুক্ত হয়। এর আগে এমন দফা আর সংঘবদ্ধ টানা আন্দোলনের ঘটনা বাংলাদেশের টিভি ইতিহাসে ঘটেনি। দেখা মেলেনি টিভি সংশ্লিষ্টদের মধ্যেিএমন বৈপ্লবিক চেতনা।

এফটিপিও: এখানেও দেখা মিলেছিল স্বৈরাচার আন্দোলনের নূর হোসেনকে!গেল বছর (২০১৬) নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টিভি অঙ্গনের ১৩টি সংগঠন এক ছাতার নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল কিছু যৌক্তিক দাবি নিয়ে। সবাই মিলে এর নাম দিয়েছিলেন ‘ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অরগানাইজেশন’। মানে সংক্ষেপে ‘এফটিপিও’। সংশ্লিষ্টদের দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-

বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে বাংলায় ডাবকৃত বিদেশি সিরিয়াল বা অনুষ্ঠানের প্রচার বন্ধ করতে হবে।

টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ, ক্রয় ও প্রচারের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট/অ্যাজেন্সির হস্তক্ষেপ ছাড়া চ্যানেলের অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

এফটিপিও: আন্দোলন শেষ নাকি স্থগিত!টেলিভিশন শিল্পের সর্বক্ষেত্রে এআইটির নুন্যতম ও যৌক্তিক হার পুননির্ধারণ করতে হবে।

দেশের টেলিভিশন শিল্পে বিদেশি শিল্পী-কলাকুশলীদের অবৈধভাবে কাজ করা বন্ধ করতে হবে, প্রভৃতি।

টেলিভিশন চ্যানেল ও সরকারের প্রতি এসব দাবি নিয়ে আন্দোলন-সভা-সমাবেশ করলেও গেল বছর ২৭ ডিসেম্বর হঠাৎ এক বিবৃতিতে কর্মসূচি স্থগিত করার ঘোষণা দেয় এফটিপিও। কিন্তু কেন এই আকস্মিক থমকে যাওয়া? ২৭ ডিসেম্বরের ওই ঘোষণায় ছিল মাত্র ১০ দিনের জন্য স্থগিত হচ্ছে এফটিপিওর কর্মসূচি, সংগঠনটির আহবায়ক মামুনুর রশীদ এমনটাই জানিয়েছিলেন। ১০ দিন পেরিয়ে এখন ৯০দিন কেটে গেছে। এখনও কোনও নতুন ঘোষণা আসেনি এফটিপিও’র তরফ থেকে। তবে কি স্থগিতের কথা বলে পিছু হটেছেন সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ? এমনই জল্পনার দানা বাঁধতে শুরু করেছে সর্বত্র।

এফটিপিও: বক্তব্য রাখছেন আন্দোলনের প্রধান মুখ মামুনুর রশীদএফটিপিও’র এ আন্দোলনকে মোটেও যৌক্তিক বলে মনে করেন না সিনিয়র অভিনেত্রী শিরিন বকুল। তিনি বলেন, ‘এটা কোনও আন্দোলনই হয়নি। সে আন্দোলন যৌক্তিক ছিল না। যার যার অবস্থান থেকে তাকেই লড়তে হবে। এখন অভিনয় শিল্পীদের প্ল্যাটফর্ম হয়েছে। শিগগিরই তাদের একটা নীতিমালা আসবে। নাটকের জন্য যা যা করার তার একটা পরিকল্পনা করা হবে। তাই বলছি, আন্দোলন করতে হলে এত মানুষের দরকার পড়ে না। আমার নিজের নাটকই তো দর্শক দেখেন না। বিদেশী সিরিয়াল বন্ধ কিংবা ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করে কী লাভ বলুন? আগে বাজেট ভালো হতে হবে। ভালো গল্প বাছাই করতে হবে। তা না হলে, কিছুই হবে না।’

এফটিপিও: জেগেছিল তরুণ নেতৃত্বএদিকে বেশ ক’জন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিনয়শিল্পী-নির্মাতা বিদেশি সিরিয়াল প্রচার বন্ধসহ নানা দাবিতে ওই আন্দোলন কর্মসূচিকে ‘অযৌক্তিক’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন সম্প্রতি। শুধু তাই নয়, অনেকেই বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও প্রকাশ করেছেন। বলছেন, শিল্পীদের অধিকার আদায়ের জন্য এভাবে রাজপথে নামাটা উচিত নয়। পাশাপাশি অনেকেই মনে করছেন সরকার ও টিভি চ্যানেলগুলোর তোপের মুখে পড়ে পিছু হটেছে এফটিপিও। এমনও বলা হচ্ছে, এই আন্দোলনের সঙ্গে এমন অনেকেই জড়িত আছেন, যারা মূলত টিভি চ্যানেলের চলমান বিশৃঙ্খলার পেছনে দায়ী! অর্থাৎ সর্ষের ভেতরেই নাকি ভুত।

এফটিপিও: বক্তব্য রাখছেন তারিন জাহানতবে অন্য আভাসও আছে। সংগঠনটির তরফ থেকে বিভিন্ন সূত্রের খবর এমন- এসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন এফটিপিও’র নেতৃবৃন্দ এবং অভিযুক্ত টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ!

বিষয়টি নিয়ে সংগঠনের আহ্বায়ক মামুনুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিটিভির মহাপরিচালনককে নিয়ে একটি কমিটি হয়েছিল তথ্যমন্ত্রণালয়ে। সেখানে আমি ও গাজী রাকায়েত আছি। আন্দোলনের দাবিগুলো নিয়ে ক্যাবিনেটে সুপারিশ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় বলেছে আরও কিছুদিন সময় দেওয়ার কথা। আমরাও সেটা দিয়েছি। কারণ এখানে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার রয়েছে। যা আসলেই একটু সময় নিতে হবে। আমরাও সে অপেক্ষায় আছি। প্রত্যাশা করছি, আমাদের দাবিগুলোর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শিত হবে।’

এফটিপিও: চঞ্চল চৌধুরীর জ্বালাময়ী ভাষণঅন্যদিকে এফটিপিও’র এ আন্দোলন কর্মসূচী কি স্থগিত নাকি বন্ধ রয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছিল সংগঠনটির অন্যতম সংগঠক ও সদস্য সচিব এবং ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি গাজী রাকায়াতের কাছে। তিনি বলেন, ‘কোনও বন্ধ-টন্ধ নয়। আমাদের আন্দোলন চলছে। মাঠের আন্দোলন বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকারকে আমরা আমাদের সুপারিশগুলো দিয়ে দিয়েছি। তারা কিছু সময় চেয়েছে। আমরাও অপেক্ষায় আছি। সরকার বিলম্ব করলে আমরা সব সংগঠনগুলোকে নিয়ে আবার বসবো।’

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে সরকার আর কতদিন বিলম্ব করলে পরে গেল নভেম্বরের মতো সংগঠনগুলো আবারও নড়ে-চড়ে বসবে? স্পষ্ট জবাব মিলছে না কারও কাছ থেকেই।

প্রসঙ্গক্রমে সদ্য নির্বাচিত অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম ঠিক একই সুরে বলেন, ‘ঠিক স্থগিত বলা যাবে না। মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। তাই আমরা এ মুহূর্তে আর কোনও আন্দোলনে নামছি না। মানে রাজপথের আন্দোলনে নামা হচ্ছে না। সেজন্যই অপেক্ষায় আছি।’

এফটিপিও: ডলি জহুর ও অরুণা বিশ্বাসের মাঝে শিরিন বকুলএদিকে অনেকের মতে এফটিপিও থমকে গেছে কোনও এক অজানা কারণে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসিম আরও বলেন, ‘দেখুন আমরা কিন্তু সংকটের মাঝে এখনও আছি। এমন না যে সংকট কেটে গেছে। তাই আমাদের আন্দোলন অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করাটা ভুল হবে।’

উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথম সপ্তাহে টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন, ডিরেক্টরস গিল্ড, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ, অভিনয়শিল্পী সংঘ, ক্যামেরাম্যান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, শুটিং হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, টেলিভিশন টেকনিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, টেলিভিশন লাইট হাউস অ্যাসোসিয়েশন, টেলিভিশন লাইট ত্রু অ্যাসোসিয়েশন, সহকারী পরিচালক সমিতি, প্রযোজনা ব্যবস্থাপক সংগঠনগুলো এক ছাতার নিচে এসে ‘এফটিপিও’ গঠন করে। নাট্যজন মামুনুর রশীদকে আহ্বায়ক ও গাজী রাকায়েতকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। এর পরই একাধিক সংবাদ সম্মেলনের পর ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে।

এফটিপিও: কড়া রোদ থেকে বাঁচতে চাইছিলেন প্রবীণ অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান‘শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাঁচাই’ শিল্পী-কলাকুশলীদের এমন স্লোগানে সেদিন উত্তাল হয়ে উঠেছিল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। বিদেশি সিরিয়াল বন্ধের জন্য ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয় চ্যানেলগুলোকে। কিন্তু বন্ধ না হওয়ায় ঘোষণা অনুযায়ী ১৯ ডিসেম্বর দীপ্ত টিভির সামনে ও ২০ ডিসেম্বর একুশে টিভির সামনে অবস্থান নেয় এফটিপিও। পরবর্তীতে এসএ টিভি ও মাছরাঙার সামনে অবস্থান নেয়ার কথা থাকলেও ২৭ ডিসেম্বর ১০দিনের জন্য সব কর্মসূচি স্থগিত করে এফটিপিও।

এফটিপিও: ঐতিহাসিক কল-রেডী মাইক্রোফোন সামনে নিয়ে শহীদ মিনার মঞ্চে ডলি জহুরগেল বছর ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত এফটিপিও’র মহাসামাবেশ থেকে ছবিগুলো তুলেছেন সাজ্জাদ হোসেন
/এমকে/এমএম/