সে রাতে কুয়াশা ছিল খুব। লাইট করতে ক্যামেরাম্যান সময় নিচ্ছিলো অনেক। আমি আর প্রিয়া আমান অনেক সময় ধরে তাজিন আপার গল্প শুনলাম। কাঁঠাল গাছের নিচে হিমধরা ঠান্ডায় সেই রাতে তিনি আমাদের কোনও সুখের গল্প শুনাতে পারেনি। দূরের বিলে তাই কোনও ডাহুক ডাকেনি। একটাও জোনাকি জ্বলেনি শিশির ভেজা ঘাসে!
আমরা দুজন একের পর এক দুখের গল্প শুনেছি। তাজিন আহমেদ বলে গেছেন তার মায়ের গল্প, মিথ্যা ভালোবাসার গল্প, ভাই-বোন আর বাবা না থাকার গল্প। প্রিয়াকে বলছিল, বাসায় ঢুকলে খুব ভয় লাগে রে। রাতে ঘুমাতে পারি না ভয়ে। একা থাকতে কষ্ট হয় অনেক। যে মানুষটা ভয় পেতো, রাতে লাইট জ্বালিয়ে রাখতো, সে মানুষটা একা, একটা অন্ধকার ঘরে কীভাবে আছে এখন? কেমন করে আছে! আমার জানতে ইচ্ছে করে! ভিশন ইচ্ছে করে!
‘বিদেশি পাড়া’ নাটকে ২৭ জন আর্টিস্ট ছিল। কারো জন্য চুক্তিপত্র লাগেনি। কাউকে চুক্তিপত্রে সই করে অভিনয় করাতে হয়নি। অথচ কিছু আর্টিস্ট রোজ আমাকে বুদ্ধি দিতো, আমার প্রডিউসার রিপনকে ফিস ফিস করে বলতো, তাজিন আহমেদকে চুক্তিপত্রে সই করিয়ে নিন! না হলে ঝামেলা করতে পারে।
না। তিনি কোনও দিন ঝামেলা করেননি। তার কোনও ডেট ফাঁসানোর গল্প আমার সাথে নেই। দেরি করে আসার গল্প আমার সাথে নেই। চাওয়া পাওয়ার গল্প আমার সাথে নেই। তাজিন আহমেদ আসলে দুর্ভাগা। বছরের পর বছর একসাথে কাজ করার পরও অনেক কো-আর্টিস্টের্ কাছ থেকে তিনি ভালোবাসা পাননি বলেই দুর্ভাগা। ভালো অভিনয় করার পরও নিজের জন্য কিছু করতে পারেননি বলে দুর্ভাগা। নির্মাতাদের দৃষ্টির বাইরে তাজিন আহমেদকে সরিয়ে রেখেছিলেন তারই প্রিয় মানুষরা। ভালোবাসার কিছু কো-আর্টিস্ট! বোকা মানুষটা সে কথা বুঝতেই পারলো না কোনও দিন। জানতেই পারলো না, তার অস্তিত্ব কতো সহজে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল টিভি পর্দা থেকে!
তাজিন আহমেদকে নিয়ে আমি কোনও ফেসবুক পোস্ট দেইনি। দেইনি কোনও ছবি। কী লিখবো, কী লেখা উচিত! শুধু মনে মনে ভেবেছি, কতোটা অভিমান ছিল তার! কতোটা দহন ছিল, কতোটা ব্যথায় এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। কিছু মানুষ তো তার পাশে ছিল। স্বার্থপরতার মিছিলে যোগ না দেওয়া কিছু মানুষ তো ঠিকই ভালোবাসতো তাকে। অভিমানী মানুষটা, ভয় পাওয়া মানুষটা, অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকা মানুষটা কী জানতো না—ভালোবেসে চলে যেতে নেই!
তাজিন আহমেদ অভিনীত একুশে টিভিতে প্রচার হওয়া শেষ দীর্ঘ ধারাবাহিক ‘বিদেশি পাড়া’র কিছু অংশ:
* হাসপাতালে অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ, অবস্থা সংকটাপন্ন
* অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ আর নেই* ভালো লাগা মুহূর্তগুলো সবসময় স্মৃতি হয়ে যায়: তাজিন আহমেদ
* ‘হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি কাঁদিয়ে চলে গেল’
* মরদেহ হিমঘরে, বুধবার দাফন
* বাবার কবরেই সমাহিত তাজিন আহমেদ