২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের ‘রাজকাহিনী’ ছবিটি মঙ্গলবার কলকাতার সল্টলেকে আইনক্সে দেখতে দেখতে মনে হলো, পরিচালক সৃজিত মুখার্জি একটা নতুন কাহিনী শোনালেন। সঙ্গে যোগ হলো বেশ কিছুটা মশলাও।
ভারত ভাগ ও পাকিস্তানের জন্ম, তার কুফল ও অভিশাপ নিয়ে বহু সিনেমা হয়েছে। ইংরেজরা জওহরালল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে খুশি করার জন্য দিল্লিতে বসে ভারত ভাগ করেছিল মানচিত্রের ওপর ভিত্তি করে। ওই সময় দিল্লি ও করাচির গদিতে বসার জন্য ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, দেশভাগের ফলে কোটি কোটি মানুষ যে ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে গেল, তার খোঁজ কেউ নিল না। মূল আবেগ যেন এখানেই।
ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গ্রন্থ ‘রাজকাহিনী’র কথা। দেখে মনে হলো, পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় সে গ্রন্থ মাথায় রেখে নতুনভাবে ‘রাজকাহিনী’ তৈরি করছেন। অবনীন্দ্রনাথ তার ‘রাজকাহিনী’তে রাজস্থানের চিতোরে ১২০০০ রাজপুত মহিলা অগ্নিতে আত্মাহুতির কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। আর এখানেও যেন তাই।
সৃজিতের ‘রাজকাহিনী’তে স্থান পেয়েছে ১৯ জন বারবনিতা বা যৌনকর্মী। এখানে গুলি খেয়ে ও আগুনে মৃত্যুবরণ করার কাহিনী দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে পরিচালকের প্রশংসা না করলেই নয়। সৃজিত বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছেন এতে।
এবার একটু কাহিনীতে ফেরা যাক। দিল্লিতে বসে ভাইস রয় ঠিক করে দিলেন যে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত কোথা দিয়ে যাবে। তাকে একেবারে পাক্কা জহুরি ভেবে সেই মানচিত্র নিয়ে নিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা। আর এরাই সীমান্ত ঠিক করার কাজে সরকারি অফিসার বনে গেলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতা তথা অফিসার প্রফুল্ল সেনের ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের অফিসার হিসেবে কৌশিক সেন যেন একেবারে যুতসই।
এদিকে দিল্লি ও করাচি থেকে বারবার তাগাদা আসছে সীমারেখা দ্রুত চিহ্নিত করে খুঁটি ও কাঁটাতারের বেড়া বসাতে হবে। শেষমেশ দুই দেশের নেতারা ঠিক করলেন সরাসরি পুলিশি বল প্রয়োগ না করে কৌশলে বেগম জানদের হঠিয়ে কুঠিবাড়ি ভেঙে সীমান্ত ঠিক করতে হবে।
মেখিলিগঞ্জের এক গুণ্ডাবাহিনীর সরদারের শরণাপন্ন হল সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা। মদ ও টাকার লোভে ৫০ জনের এক বাহিনী পুলিশের বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুঠিবাড়িতে। বেগম জানের প্রমিলা বাহিনীও তৈরি ছিল বন্দুক নিয়ে। দীর্ঘক্ষণের লড়াইয়ে বেগম জানের ১৯ জন বারবনিতা মারা গেল। কুঠিবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। বৃদ্ধা কমলাসহ বেগম জানের ৬ জন বারবনিতা ওই আগুনে আত্মাহুতি দিলেন।
ছবির মুহূর্তগুলো একবারের জন্য হলেও দর্শকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ১৯৪৭ সালের সে সময়ে। এখানেই সৃজিতের স্বার্থকতা বলে মনে হয়। ছবিতে জয়া আহসান ছাড়া বাকি প্রায় সবাই কলকাতার এবং হিন্দি ভাষার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সায়নী ঘোষ (কলি), সোহিনী সরকার (দুলি), রুদ্রনীল ঘোষের সঙ্গে কম যাননি বাংলাদেশের এ তারকা। মনেই হননি তিনি ভারত বা কলকাতার সংস্কৃতির কেউ নন। বিশেষ করে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে জয়া নিচ থেকে বারান্দায় উঠে আসার সময় বলা, ‘দেখতেসেন না, মায়ের কথা হচ্চে’।
ছবিতে যেমন ছিল বেশ কিছু গালিমাখা শব্দ। আবার পতিতালয় দেখাতে গিয়ে বারবারই মেয়েদের শরীরের উপরের অংশ দেখানোর প্রতিযোগিতা হয়েছে। ছিল আদিখ্যেতারও ফুলঝুরি। যেমন বেগম জান বেশিরভাগ সময় কথা বলেছে হিন্দিমিশ্রিত শব্দে। বারবনিতাদের কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে পরিচালক হয়তো দেখাতে চেয়েছেন, সমাজ সংস্কারকরা হিন্দু, মুসলিম, জাতপাত নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু পতিতালয়ের কোনও ধর্ম বা জাত নেই। শরীরটাই আসল। এরপরও একটি প্রশ্ন এসেছে তা হলো কুঠিবাড়ির অবস্থান। ‘রাজকাহিনী’তে দেবীগঞ্জ ও হলদিবাড়ির মাঝখানে পড়ে যাওয়া এই বেগম জানের কুঠিবাড়ি লড়াইয়ের শ্যুটিংস্থল উত্তরবঙ্গ নয়। ধূ-ধূ প্রান্তরের মাঝে মাথা তুলে রয়েছে একা কুঠিবাড়ি। চারপাশ জনমানবশূন্য। কীভাবে ওই নির্জন এলাকায় জমজমাট দেহব্যবসা চলে- এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
তবে সব মিলিয়ে সিনেমাটা বাংলাদেশে মুক্তি পেলে সেখানকার মানুষও আলাদাভাবে এটি গ্রহণ করবে বলেই মনে হলো।
/এম/