কান উদ্বোধনে যাচ্ছেন না সাদ-বাঁধন

প্যারিসের বিষণ্ন সন্ধ্যায় মুখোমুখি বাঁধন ও রেহানা

বিষণ্ণ মন নিয়ে প্যারিসের নির্জন বাগান বাড়িতে নিজের রুমে বসে ব্যাগ গুছাচ্ছিলেন ঢাকার বাঁধন। বাংলাদেশ সময় সোমবার (৫ জুলাই), রাত ঠিক ১১টার সময় আলাপ হলো। দেয়ালে দিকে চোখ তুলে স্থানীয় সময় জানালেন কান-খ্যাত রেহানা, প্যারিসের ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা ৭টার ঘর ছুঁলো। ঠিক ১২ ঘণ্টা পর প্রিয় রুম, দেয়াল, বাগান, রান্না ঘর, ১০ দিনের ঘরবন্দি স্মৃতি আর বাড়ির পরতে পরতে লেপ্টে থাকা মায়া- সব ফেলে ফের ছুটতে হবে টিম ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-সদস্যদের। প্যারিস থেকে ৭শ’ কিলোমিটার দূরে, যেখানে লালগালিচা পেতে অপেক্ষায় রয়েছেন কান-আয়োজকরা। তার আগেই প্যারিসের বিষণ্ন সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউন-এর মুখোমুখি বসলেন বাঁধন অথবা রেহানা কিংবা দু’জনেই-

ছবির দুটি দৃশ্যে বাঁধনবাংলা ট্রিবিউন: শুরুতেই বলছিলেন মন বিষণ্ন। কারণটা কি খুব বেশি ব্যক্তিগত। বলা যাবে?

আজমেরী হক বাঁধন: ঠিক মনও না, আসলে আমার শরীরটা খারাপ। সেটা এখানে এসে নয়, ঢাকা থেকেই। বলতে পারেন, কানের খবরটি পাওয়ার পর থেকে। শরীর খারাপ হলে তো মনটাও খারাপ থাকে।

বাংলা ট্রিবিউন: শরীর খারাপ বলতে কোভিড সিম্পটম নয় তো!

আজমেরী হক বাঁধন: আরে না। তা হবে কেন। এখানে আসার আগে টেস্ট করালাম। টানা ১০ দিন বাড়ি-বন্দি আছি। কাল (৬ জুলাই) যাবো তাই আজ (৫ জুলাই) আবার টেস্ট করালাম। কোভিড সিম্পটম না। আমার আসলে মূল সমস্যা হচ্ছে ক্রনিক ডিপ্রেশন। মানসিক চাপ এতো বেশি নিয়ে ফেলেছি, রিকভার করতে পারছি না। বরং দিন যতো যাচ্ছে, চাপটা আরও বাড়ছে।

বাংলা ট্রিবিউন: প্যারিস শহরের অদূরে এই বাংলো বাড়ির জন্যেও তো মায়া জন্মাবার কথা। সেটিও ছাড়তে হচ্ছে...

আজমেরী হক বাঁধন: নিশ্চয়ই। মায়া মানে অসম্ভব মায়া। পিছুটান বড় ভয়ংকর। সবচেয়ে বড় মায়ার জালটা তো ছিঁড়তে হলো ঢাকায়। বাচ্চাটা, বাবা আর মাকে- রেখে এতোগুলো দিন এতোটা দূরে এসে- আর তো থাকিনি। মায়া বড়ো কঠিন অসুখ। এখানে এসে এই বাড়িটাকেও কতো আপন আর নিরাপদ মনে হয়েছে। কতোগুলো দিন-রাত সাতজন মানুষ একসঙ্গে আছি। ঝগড়া, গল্প, অভিমান, উচ্ছ্বাস, উৎকণ্ঠা- সবই ছিলো এই দিনগুলোতে। এসব ফেলে আবার যেতে হচ্ছে নতুন শহরে, কান-তীরে। মায়ার তো আসলে শেষ নেই। এটাই বুঝি জীবন।সাদ ছাড়া দলের ৬ সদস্য, প্যারিসের ভাড়া বাংলোয়

বাংলা ট্রিবিউন: কোভিড পরীক্ষা করেছেন আজ। পাশ করলেন তো!

আজমেরী হক বাঁধন: এখনও ফলাফল পাইনি হাতে। রাতের মধ্যে পেয়ে যাবো। ফলাফল ইতিবাচকই আসবে, মানে নেগেটিভ। ইনশাল্লাহ।

বাংলা ট্রিবিউন: রাত পোহালেই (৬ জুলাই) কানতীরে পর্দা উঠছে ৭৪তম উৎসবের। বাংলো ছাড়ছেন কখন?

আজমেরী হক বাঁধন: ভোর সাতটায় ট্রেনের টিকিট করা। কোভিড রেজাল্ট পেয়ে যাবো এরমধ্যে। ব্যাগ গুছাচ্ছি সবাই। এই রাতে ঘুম আর হবে না আমাদের।

বাংলা ট্রিবিউন: ট্রেন! সকাল ৭টা? প্যারিস থেকে কানের দূরত্ব তো কম নয়, প্রায় ৭শ’ কিলোমিটার। উদ্বোধনী আয়োজন ধরার ইচ্ছে নেই কি!

আজমেরী হক বাঁধন: নেই। সেজন্যই ট্রেন জার্নিটা বেছে নিলাম আমরা! দেখতে দেখতে যাই…

বাংলা ট্রিবিউন: বিষয়টি কি এমন- অফিসিয়াল সিলেকশনের অংশ আঁ সার্তে রিগারের প্রথম ছবি হয়েও ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সংশ্লিষ্টরা উৎসব উদ্বোধনে কোনও চেয়ার পাচ্ছে না! মানে নিয়মটা কি এমনই-

আজমেরী হক বাঁধন: এমন না। উৎসবের নিয়ম হচ্ছে এই বিভাগে চূড়ান্ত হওয়া সকল ছবির নির্মাতা, প্রধান শিল্পী ও প্রযোজক স্বাভাবিক নিয়মেই উদ্বোধনী আসরে বিশেষ আমন্ত্রণ পায়। আমরাও পেয়েছি। কিন্তু সেটাতে আমরা অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

পোস্টারে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’

বাংলা ট্রিবিউন: ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... (!!!)

আজমেরী হক বাঁধন: আরেকটু পরিষ্কার করে বলছি। এই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত কিন্তু টিম-সাদ এর টিম স্পিরিটের অন্যতম অংশ। আমরা শুরু থেকে এভাবেই চলছি। ভাবুন একবার, একসঙ্গে আমরা সাতজন মানুষ এলাম। এ পর্যন্ত আমাদের সবকিছু একসঙ্গে। কে ডিরেক্টর কে ডিওপি কে কতো বড় তারকা- সেটি এখানে একেবারেই বাক্সবন্দী বিষয়। কানের রীতি অনুযায়ী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিলে আমি, নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ আর প্রযোজক জেরেমি চুয়া নিতে পারি এখনও। তাহলে আমাদের সঙ্গে যারা এতোটা পথ এলেন- সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার শৈব, কালারিস্ট চিন্ময়, প্রোডাকশন ডিজাইনার উজ্জ্বল, সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন আর একজিকিউটিভ প্রোডিউসার বাবু; তাদের কী হবে! তারা হোটেলে আর আমরা লালগালিচায়, সেটিকে সাদ সমর্থন করেন না। সে জন্যই আমাদের এই সিদ্ধান্ত। এতে আমাদের মধ্যে কোনও দুঃখ নেই, বরং স্বস্তি আছে। আমি তো আর বাঁধন নেই, রেহানা বলছি।

বাংলা ট্রিবিউন: ৭ জুলাই কানের পালে দো ফেস্টিভাল ভবনের সাল দুবুসি প্রেক্ষাগৃহে সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় দুপুর ৩টা ১৫ মিনিট) প্রথম প্রদর্শন হবে আপনাদের ছবি। এদিন সবাই যাচ্ছেন তো!

আজমেরী হক বাঁধন: সেদিন সবাই যাবো। সেটি নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই নয়, ১৬ জুলাই আঁ সার্তে রিগার বিভাগের অ্যাওয়ার্ড ডিক্লারেশনের সময় বাংলাদেশ থেকে অডিয়েন্সে থাকবো আমরা ৮ জন। এই সাতজনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে আমাদের সহ-প্রযোজক রাজীব মহাজনেরও।বাংলোর উঠোনে চলছে বারবিকিউ পার্টি

বাংলা ট্রিবিউন: যতদূর জানা গেছে আঁ সার্তে রিগার বিভাগে আসলে একটি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। যেটা ১৬ জুলাই ঘোষণা করা হবে। মানে উৎসব শেষের আগের দিন। আর সেই অ্যাওয়ার্ডটি মূলত দেওয়া হয় সবগুলো ছবি থেকে সেরা অভিনয়শিল্পীকে। ফলে এই স্বীকৃতিটি অর্জন করা যেমন কঠিন, তেমন ওজনদারও। এবার সারা পৃথিবীর আড়াই হাজার সিনেমা থেকে এই বিভাগে জায়গা পেয়েছে মাত্র ৪৪টি। এর মধ্যে একটি হলো ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। বাংলাদেশের প্রথম ছবি। প্রশ্ন নয়, পাঠকদের জন্য একটু বিস্তারিত বলা। কান-তীর থেকে জোর গুঞ্জন ভেসে আসছে ঢেউয়ে ঢেউয়ে, এবারের আসরের এই বিভাগের একমাত্র সোনার হরিণটি আসছে আপনার ঘরে। গুঞ্জনের বিপক্ষে আত্মপক্ষসমর্থন করুন।

আজমেরী হক বাঁধন: ধন্যবাদ। এই যে বলছেন, গুঞ্জন হলেও এটাই আমার জন্য পরম পাওয়া। যদিও এই গুঞ্জনের ভিত্তি নেই, আমাকে ঘাবড়ানোর জন্য বানানো কথা বললেন! এমনিতেই ঘাবড়ে আছি। তো এখানে সব ছবি প্রিমিয়ার হওয়ার আগে এমন কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ারও সুযোগ নেই। এখানে অংশ নেওয়া প্রতিটি ছবিই এই পুরস্কারের দাবি রাখে। আমরাও প্রত্যাশা করছি। সাত সমুদ্র তেরো নদী ভেসে ভেসে আসার কারণটাও তাই। আমার শুধু একটু বাড়তি উদ্দেশ্য আছে, সেটি হলো বড় পর্দায় ছবিটি প্রথমবারের মতো দেখা! তবে যাই হোক অথবা না হোক- অল ক্রেডিট গৌজ টু মাই ডিরেক্টর। ধরুন, আমিই পেলাম। একটু ফ্যান্টাসি করি, মনটাও ভালো না। সেরা পারফরমার হিসেবে আমি পেলাম স্বীকৃতিটা। কিন্তু সেটি তো নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের পারফরমেন্সের কারণে। আমি তো তার চাওয়াটাকে অনুসরণ করেছি মাত্র। আর কিছুই করিনি। ফলে সেরার স্বীকৃতি পেলেও, সেটির মালিক আসলে আমি নই। সাদ ও তার পুরো টিমের ফসল সেটি।

বাংলা ট্রিবিউন: কানের পথে দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা শুভ হোক। আগাম অভিনন্দন। ফিরছেন কবে নাগাদ।

আজমেরী হক বাঁধন: ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি। ১৭ জুলাই উৎসবের পর্দা নামছে। আমরা ফিরছি ১৮ জুলাই।